পছন্দ না হলেই শিবির!
ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের চার শিক্ষার্থীকে রড, লাঠি ও স্টাম্প দিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। মারধরের শিকার শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে হলের অতিথি কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর শেষে রাত ২টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়। তবে অভিযোগের সত্যতা না ‘পাওয়ায়’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গতকাল বুধবার বিকেলে ওই চারজনকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, এই চার শিক্ষার্থীর কাছে শিবিরসংশ্লিষ্ট বই ছিল। তাই তাদের ধরে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মারধর করা হয়নি। এদিকে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গতকাল বিকেলে ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করেছে সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্য।
মারধরের শিকার ওই চার শিক্ষার্থী হলেন ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের সানোয়ার হোসেন, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুকিম চৌধুরী, একই বর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মিনহাজ উদ্দিন এবং আরবি বিভাগের আফসার উদ্দিন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১১টার দিকে জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের নিয়মিত ‘গেস্টরুম’ চলছিল। তখন হল শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা ও হল সংসদের সহসভাপতি সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে শিবির সন্দেহে সেখানে মুকিমকে ডেকে আনা হয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে শিবিরকর্মী হিসেবে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য মুকিমকে চাপ দিতে থাকেন। তিনি স্বীকার না করায় লাঠি, স্টাম্প ও রড দিয়ে তাকে বেধড়ক মারধর
করা হয়। পরে তার ফোনের চ্যাটলিস্ট (মেসেঞ্জার) দেখে সানোয়ারকে গেস্টরুমে আনা হয়। সেখানে তাকেও বেধড়ক মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতারা। মারধর সহ্য করতে না পেরে দুজনে মেঝেতে পড়ে যান।
তারা আরও জানান, এরপর মিনহাজ ও আফসারকে ধরে আনা হয়। সেখানে রাত ২টা পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এরপর প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়। প্রথমে পুলিশ তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের থানায় নেওয়া হয়। তবে শিবিরের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় বুধবার বিকেল ৪টার দিকে ওই চারজনকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ।
মারধরের শিকার ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুকিম চৌধুরী বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে হলের গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে আমাকে একটা ফেইক স্ক্রিনশট দেখিয়ে বলা হয়, আমি শিবির। পরে হল সংসদের রুমে নিয়ে আমাকে রড, লাঠি, স্টাম্প দিয়ে মারধর করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো তারা আমাকে মারধর করে।’ পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নির্যাতনকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন মুকিম।
ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হল প্রশাসনের মাধ্যমে এ বিষয়ে অবহিত হয়েছি। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যদি ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া না যায় তাহলে তাদের কোনো ধরনের হয়রানি করা যাবে না, এটা আমরা বলে দিয়েছি।’
শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, ‘রাত আনুমানিক ৩টার দিকে হলের চার শিক্ষার্থীকে থানায় সোপর্দ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। পরিবারের জিম্মায় ওই শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের নেতা আমির হামজা বলেন, ‘এই চার শিক্ষার্থীর কাছে শিবিরসংশ্লিষ্ট বই ছিল। তাই তাদের আটক করে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মারধর করা হয়নি।’ তবে তাদের কাছে শিবিরসংশ্লিষ্ট কী বই ছিল—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘এই চার শিক্ষার্থীর কাছে বিভিন্ন জিহাদি বই পাওয়া গেছে। এরা শিবিরের রাজনীতি করে। বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছিল তারা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের কেউ মারধর করেনি। হয়তো পালাতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। হল প্রশাসনকে বলব একটি তদন্ত কমিটি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।’
এদিকে চার শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে গতকাল বিকেল ৩টার দিকে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে জহুরুল হক হলের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে। সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্যের ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে ভিপি নুর বলেন, ‘আমি ডাকসুর ভিপি হয়েও ডাকসু ভবনে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছি। তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়? দলকানা প্রশাসন ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। জহুরুল হক হলে গতকাল রাতে চারজনকে ছাত্রলীগ নির্যাতন করে, তাদের বেধড়ক পিটিয়েছে। যে নির্যাতন করেছে তাদের আমি শাহবাগ থানায় গিয়ে দেখেছি। তাদের আবরারের মতো পিটিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে, স্টাম্প দিয়ে পিটিয়েছে। হয়তো এই চারজনের মধ্যে কেউ একজনের আবরারের মতো পরিণতি হতে পারত।’
আইএইচটির শিক্ষার্থীকে পেটাল ছাত্রলীগ : রাজধানীর মহাখালীতে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিয়ান সজীবকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বেধড়ক পিটিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার একাধিক বন্ধুর ভাষ্য, রাতের খাবার কিনে হলে ফেরার পথে গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে ক্যাম্পাসের মাঠে আইএইচটি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান রেজার নেতৃত্বে অন্তত ১৫-২০ জন মিলে সজীবকে রড, লাঠি ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ফেলে রাখে। পরে হোস্টেল সুপার মাহমুদুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে আইএইচটি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান রেজার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। আইএইচটির শরীফ মোহাম্মদ হলের সহকারী হল সুপার সুলতান মাহমুদ বলেন, সজীব হলের চতুর্থ তলার ৪০২ নম্বর রুমে থাকতেন। তবে কারা কী কারণে তাকে মেরেছে তা বলতে পারব না। সজীবের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকায়। বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বলেন, এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। তারপরও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছি।