সম্পাদক পরিষদ দলকানা ও মেরুদন্ডহীন!
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সহ প্রতিষ্ঠান মাসিক কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছে জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’।
বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, আমরা মনে করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে যার প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে, মতিউর রহমান এবং অন্যদের জন্য যেখানে সমন জারি করাই যথেষ্ট ছিল, সেখানে সে ঘটনায় তার ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা গণমাধ্যম তথা সংবাদকর্মীদের ভীতিপ্রদর্শন ও হয়রানির চেষ্টা স্পষ্ট সংকেত বহন করে- বিশেষত প্রথম আলোর প্রথিতযশা সম্পাদক যখন দুর্ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আমরা শঙ্কা ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, অস্বাভাবিক দ্রুততায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রভৃতিসহ মানহানির মামলার আইনগুলির ক্রমবর্ধমান অপব্যবহার বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে একটি নিবর্তনমূলক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং গণমাধ্যমকে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়তে হচ্ছে। এসব তৎপরতা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন নেতিবাচক মাত্র যোগ করবে। আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি, এ অবস্থায় স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত ভূমিকা পালন করা গণমাধ্যমের জন্য উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়েছে।’
প্রথম আলো পত্রিকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান কিশোর আলো পত্রিকার অনুষ্ঠানে মূলত পত্রিকাটির কর্ণধার আনিসুল হকের অবহেলার কারণে স্কুলছাত্র আবরারের মৃত্যু হয়েছে। এটাকে হত্যাকাণ্ডই বলা যায়। প্রথম আলোর সম্পাদকসহ ১০ জন হত্যা মামলার আসামি। এই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় সম্পাদক পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু দেখা গেছে, একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আবদ্ধ রয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বর্ষিয়ান সম্পাদক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী আবুল আসাদ। কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের শেখ হাসিনার সন্ত্রাসীরা দৈনিক সংগ্রাম অফিসে ঢোকে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে। সম্পাদক আবুল আসাদকে যেভাবে লাঞ্চিত ও অপমান করেছে তা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের এই সন্ত্রাসীরা আবুল আসাদকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আর আওয়ামী পুলিশ একজন প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদককে থানায় নিয়ে রাতভর বসিয়ে রাখে।
পরের দিন আদালতে নিয়ে তার নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দিয়ে তাকে তিন দিনের রিমাণ্ডে নেয়ার আদেশ দেন আওয়ামী আদালতের বিচারক। সেই রিমাণ্ডের পর থেকে আজ পর্যন্ত বর্ষিয়ান এই সম্পাদক কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ রয়েছেন।
দেশে সাংবাদিকদের যতগুলো সংগঠন আছে তার মধ্যে সম্পাদক পরিষদ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। কোনো ইস্যুতে তাদের দেয়া বিবৃতিও অনেক গুরুত্ববহন করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম আলো সম্পাদকের জন্য উদ্বেগ থাকলে বর্ষিয়ান সম্পাদক আবুল আসাদের বেলায় নয় কেন?
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব এম আবদুল্লাহ বলেছেন, প্রথম আলো সম্পাদকের পরোয়ানার সমালোচনায় যেসব যুক্তি দেখাচ্ছি, সে তুলনায় আবুল আসাদকে হেনস্থা, গ্রেফতার, রিমান্ড, জামিন না দিয়ে হাই সিকিউরিটি কারাসেলে নিঃসঙ্গ বন্দী রাখার পক্ষে যু্ক্তি কি অনেক সবল? সংবাদপত্রে প্রতিদিন শত শত শিরোনাম হয়। এক দিনের একটি শিরোনামের একটি শব্দের জন্য একজন সম্পাদকের প্রায় অর্ধ শতাব্দীর সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চায় সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার এভাবে উপেক্ষা করা যায়? আবরারের মৃত্যুজনিত দায়-দায়িত্ব নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, আবুল আসাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খন্ডন করে অনুরূপ বিতর্কের ছিটেফোঁটা উপাদানও কি নেই?
তিনি বলেছেন, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান অনেক ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। সেই সম্পাদকদের সংগঠন যদি সংকীর্ণতা, দলান্ধ-ক্ষমতান্ধ মানসিকতা ও মতলবি চেতনার উর্ধে উঠে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ও আপাদমস্তক পেশাদার সম্পাদকের পাশে দাঁড়াতে না পারেন তা একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তাঁর পক্ষে শক্ত অবস্থান না নিলেও শীর্ষস্থানীয় ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সেটা প্রশংশিত হয়েছিল। আবুল আসাদের ক্ষেত্রে তাও পারেননি আমাদের সম্পাদকরা। আমার ধারণা প্রথম আলোর পক্ষে বিবৃতির ক্ষেত্রেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে বলেই বিলম্ব। দেশের মানুষ সম্পাদকদের সংগঠনকে দলকানা বা মেরুদন্ডহীন দেখতে চায় না। তেমনটা হলে একসময় ‘সম্পাদক পরিষদ’ হয়তো ‘সম্পাদক লীগ’ তকমা পাবে, যা একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মোটেই কামনা করি না।
সাংবাদিক মহল প্রশ্ন তুলে বলছেন, একজন বর্ষিয়ান সম্পাদকের ওপর এমন নির্যাতন করা সত্ত্বেও এই সম্পাদক পরিষদ একটি কথাও বলেনি। কেন? আবুল আসাদ কি সাংবাদিক নন? তিনি কি সম্পাদক নন? জামায়াতের পত্রিকার সম্পাদক হওয়ায় তার অপরাধ? তারা বলছেন, মেনে নিলাম আবুল আসাদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত। কিন্তু মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন ও ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের বেলায় নীরব থেকেছেন কেন?
তারা বলছেন, সম্পাদক পরিষদ হলো দলকানা। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা হলে তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিতে আপনারা দেরি করেননি। কারণ, শ্যামল দত্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ও আওয়ামী লীগের দালাল। মতিউর রহমান চৌধুরী, নুরুল কবির, আলমগীর মহিউদ্দিন ও আবুল আসাদ আপনাদের মতো দালালি না করায় তাদের পক্ষে কোনো বিবৃতি দেননি। তারা বলছেন, সংগঠনের নাম এখন থেকে সম্পাদক পরিষদ বাদ দিয়ে সম্পাদক লীগ লিখলেই বেশি ভালো হবে। সম্পাদক পরিষদ দেখলে মনে হয়, এ যেন সম্পাদক পরিষদ নয় এ যেন এক সম্পাদক লীগ!