পলাশীর ঘটনায় শুধু মীর জাফরকে সামনে এনে জগৎশেঠদের আড়াল করা হয়েছে: ডা: ফখরুদ্দিন মানিক

0

পলাশীর ঘটনায় চাতুরতার সাথে শুধু মীর জাফরকে বড় করে সামনে আনা হয়েছে। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের পেছনের মূল ভূমিকা পালনকারী জগৎশেঠ, রাজভল্লব, উমিচাঁদ, নন্দ নারায়নদের আড়াল করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা: ফখরুদ্দিন মানিক। তিনি আরো বলেন, ১৭৫৭ সালে যে দাসত্বের শৃঙ্খল আমাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হয়েছিলো তা আজ পর্যন্ত দেশ ও জাতি বহন করে চলেছে।

বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ১৭৫৭ সালে যে দাসত্বের শৃঙ্খল আমাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হয়েছিলো তা আজ পর্যন্ত দেশ ও জাতি বহন করে চলেছে। ১২০৩ বা ১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি উপমহাদেশে বিজয়ের সূচনা করেছিলেন। তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, ন্যায় বিচার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সভ্যতা গড়ার যে সূচনা করেছিলেন তা প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ বছর অব্যাহতভাবে চলেছে। কিন্তু পরে গোলামীর জিঞ্জির আমাদের চিন্তা, শিক্ষা, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক জায়গাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তা এখনো অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, সুকৌশলে ইংরেজদের মদদপুষ্ট লেখক, গবেষক, ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের দিয়ে আমাদের গৌরবজ্জল ইতিহাসকে আড়াল করা হয়েছে। ফলে আবার জেগে ওঠার প্রবণতা বহু ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। পলাশীর ঘটনায় চাতুরতার সাথে শুধু মীর জাফরকে বড় করে সামনে আনা হয়েছে। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের পেছনের মূল ভূমিকা পালনকারী জগৎশেঠ, রাজভল্লব, উমিচাঁদ, নন্দ নারায়নদের আড়াল করা হয়েছে। অথচ তখন গুরুত্বপূর্ণ সাতটি প্রশাসনিক পদের ছয়টিতেই ছিল হিন্দুরা। ১৯ জন রাজা-জমিদারের ১৮ জনই ছিল হিন্দু। ঐতিহাসিকরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, সেদিন যদি ষড়যন্ত্রে মীর জাফর রাজি না হতো তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা অন্য কাউকে সে জায়গায় খুঁজে নিত। তাই শুধু একজন মীর জাফরকে সামনে এনে ইতিহাস পাঠ ন্যায় সঙ্গত নয়। একইসাথে নানাভাবে সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রও খনন করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, পলাশীর ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। প্রথমত সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সুকৌশলে। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় ৬০ লাখ পাউন্ড বাংলা থেকে ইউরোপে পাচার করা হয়েছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, ইউরোপের শিল্প বিপ্লব হয়েছে আমাদের অঞ্চলের পাচার করা টাকায়। যার প্রভাবে ১১৭৬ বাংলা সনে বাংলায় দূর্ভিক্ষে প্রায় দেড় কোটি মানুষ মারা গেছেন। ষড়যন্ত্রের এ ধারা হারিয়ে যায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশের এক-এগারো, করোনাসহ বিভিন্ন ঘটনায় জাতি দেখেছে আমাদের দেশের রাজনীতি বা সরকার কোন পক্ষের দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করছে। সুতরাং দেশ ও জাতির মুক্তি, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে জাতীয় ঐক্য বড় প্রয়োজন। একইসাথে ছাত্রসংগঠনেরও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন জরুরি। আমরা আশা করি, জাতির ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রশিবির ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ।

প্রধান আলোচক কবি সোলায়মান আহসান বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞান চর্চা থেকে বিমুখ। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বর্তমান প্রজন্ম তাদের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। যা জানার সুযোগ হয় তাও মিথ্যা, একপেশে ও বিভ্রান্তিতে ভরপুর। ফলে পলাশী ষড়যন্ত্রের মত একই ষড়যন্ত্র বর্তমানে চললেও নতুন প্রজন্ম তা বুঝতে পারছে না। বিদেশীদের হাতে বড় বড় প্রজেক্ট দিয়ে দেয়া ও বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ নেয়ার মাধ্যমে জাতিকে পরনির্ভর এবং জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। জাতির তরুণরা আত্মসচেতন না হলে জাতির সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এ জন্য পলাশীসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশি বেশি ইতিহাস নির্ভর বই পড়তে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাউদ্দিন আইউবী বলেন, পলাশীর ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ডিভাইডেড এন্ড রুলের একটি প্রয়োগ মাত্র। এ প্রয়োগ শুরু হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলেই। এরপর থেকে মুসলমানরা যেখানে শক্তি অর্জন করেছে সেখানেই মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে। মুসলমানদের হাত থেকে স্পেন, পর্তুগালসহ ইউরোপকে তারা এভাবেই দখল করে নেয়। পলাশীর ঘটনার পেছনেও একই ষড়যন্ত্র হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করা হয়েছে। বর্তমান যুগেও মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বিভাজনকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে জাতিকে নানাভাবে বিভাজিত করা হয়েছে। এটি সেই ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। যেখানেই বিভাজন সেখানেই পরাজয়। আসুন পলাশীর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হই। ছাত্রশিবির ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে অতীতেও নেতৃত্ব দিয়েছে ভবিষ্যতেও নেতৃত্ব দেবে, ইনশাআল্লাহ।

কেন্দ্রীয় সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের এমন একটি প্রেক্ষাপটে আজকে আমরা পলাশী দিবসের আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়েছি যখন মনে হচ্ছে সেই আড়াই শ’ বছর আগের প্রেক্ষাপট এবং আজকের প্রেক্ষাপট হুবহু মিল রয়েছে। পলাশীর ঘটনা বাস্তবায়নের পূর্বে তৎকালীন কৃষ্টিকালচার ও চিন্তা চেতনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা করা হয়েছিল। আজও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে পাশ্চাত্যমুখী করার ষড়যন্ত্র বহুদূর এগিয়ে গেছে। সুতরাং সে সময়কার সার্বিক বিষয় চিন্তা করা তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজন রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আজকের এ আলোচনা তার খোরাক হবে ইনশাআল্লাহ।

ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কেন্দ্রীয় সভাপতি রাশেদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি জেনারেল রাজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ডা: ফখরুদ্দিন মানিক। প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও গবেষক কবি সোলায়মান আহসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাহউদ্দিন আইউবী। এ সময় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com