ভ্যাকসিন নিয়েও চলছে ভেলকিবাজি, ভ্যাকসিন আর কতদূর, কে দেবে সেই উত্তর?

ভ্যাকসিন নিয়েও চলছে ভেলকিবাজি। নানা মেরুকরণ, হিসাব-নিকাশ, দোটানা ও অনিশ্চিয়তা। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আমদানির জন্য বাংলাদেশ সরকার যে চুক্তি করেছিল, সেই চুক্তি মোতাবেক ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে কিনা, নাকি ভারতের হাতেই ঝুলে থাকবে বাংলাদেশের মানুষের ‘ভ্যাকসিন ভাগ্য’, এ নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর সেই প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হয়েছে ভারত সরকার কর্তৃক সেরাম প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাকসিনের রফতানি নিষেধাজ্ঞার শর্ত জুড়ে দেয়ার পর থেকে। এই একবার বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিন রফতানিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই, আবার শোনা যাচ্ছে ভারত তাদের জনগণকে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করে তবেই অন্য দেশে রফতানি করবে, তার আগে নয়। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্য পড়েছে। 

ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিবেশী দেশ ভারতও শিগগিরই এই টিকা দান মহাযজ্ঞ শুরু করছে। গেল কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছিল, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর সেটি যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের মানুষ পায় সেজন্য বহুমুখী প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। কোনও একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের সঙ্গে নয়, আগেভাগে ভ্যাকসিন পেতে সরকার একাধিক বিকল্প পথে চোখ রাখছে। 

অক্সেফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি মিলে করোনা ভাইরাসের যে টিকা তৈরি করছে, তার উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া। যৌথভাবে তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ নামের ওই টিকার ৩ কোটি ডোজ কিনতে গেল ৫ নভেম্বর সেরামের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। এই ৩ কোটি ডোজ দেশের নাগরিকদের বিনামূল্যে প্রয়োগের ঘোষণা আগেই দেয়া হয়েছে। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস বেসরকারিভাবেও সেরামের কাছ থেকে ৩০ লাখ টিকা আনবে।

এখন দেশের নাগরিক সমাজ ও জনমানসে উদ্বেগ বাড়ছে এই ভেবে যে, আদৌ বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসবে তো? এ নিয়ে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ঘিরেও রাজনৈতিক মহলে কথাবার্তা চলছে। দেশের মানুষ মনে করছে, সরকার কেন ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভর হলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ভারতকে আত্মনির্ভরশীল করার ক্ষেত্রে নতুন ভ্যাকসিন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছেন। এত বৃহৎ জনসংখ্যার একটি দেশে একসঙ্গে ‘কোভ্যাকসিন’ ও ‘কোভিশিল্ড’ নামে দুটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো অভাবনীয় ঘটনায় তিনি তাঁর দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও ব্যক্ত করেছেন। 

বাংলাদেশ সেরাম প্রতিষ্ঠান থেকে যে ভ্যাকসিন আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে সেটির প্রতি ডোজের ক্রয়মূল্য হবে ৪ ডলার (দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৪০ টাকা)। সব মিলিয়ে এ দাম পড়বে ৫ ডলার (দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৪২৫ টাকা)। আবার বেক্সিমকো বেসরকারিভাবে যে ৩০ লাখ ডোজ টিকা আনার কথা বলছে, সেই টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়বে ১ হাজার ২০০ টাকা। 

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আজকে ভারতের সেরামকে টিকার জন্য প্রথম ধাপে যে ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ দিচ্ছে, তার চেয়ে কম টাকায় যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০ জন বিজ্ঞানীকে ১ কোটি টাকা মাসিক বেতনে আনা হতো, তাহলেও এক বছরে দেশের ১২০ কোটি টাকা খরচ হতো। এখানে অনেক বেশি বিজ্ঞানী তৈরি হতে পারত। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশে এক বছরের মধ্যে টিকা তৈরি করা যেতো।’

‘আজকে দেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেককে যদি ৫০ কোটি টাকা সাবসিডি দেয়া হতো, তবে তারাও দেশি বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করতে পারত। আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাও আছে। তাহলে আজকে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে টিকা আবিষ্কার হতো। সেক্ষেত্রে আজ আর আমাদের অন্য কোনও দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না’- এমনটিই মনে করেন তিনি। 

এদিকে গেল এপ্রিল মাসে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় টিকা আমদানির জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১ হাজার ১২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। গতকাল একনেক সভায় এ প্রকল্পে অতিরিক্ত আরও ৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ফলে টিকার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ বেড়ে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই অতিরিক্ত বরাদ্দের অর্থায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ৫০ কোটি ডলার, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ১০ কোটি ডলার ও আর সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৭২ কোটি টাকার যোগান দেবে বলে জানা গেছে। 

সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেটার নানামুখি নমুনাও ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। তবে জনমনে প্রশ্ন, উদ্বেগ ও অনিশ্চিয়তা থেকেই যাচ্ছে। ভ্যাকসিন আর কতদূর- কে দেবে সেই উত্তর? 

Comments (০)
Add Comment