সেই প্রেমের কলেজের অপেক্ষা
কলেজ থেকেই প্রেমের শুরু। আর তাইতো যেখানে প্রেম সেখানেই কলেজ। এখানেই প্রেমের জালে বন্দি হয়েছেন রুপালী পর্দার প্রায় সকল নায়ক নায়িকা। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রেম করেছেন চুটিয়ে। কবরী, শাবানা, ববিতা, চম্পা, মৌসুমী, শাবনূর, পপি থেকে শুরু করে অপু বিশ্বাস, বুবলী কেউই বাদ যায়নি। আর যুবসমাজের হৃদয়ের রাজা সালমান শাহতো এই কলেজ থেকেই হিরো হন। রাজ্জাক, জসিম, ওয়াসিম, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন থেকে শুরু করে আশির দশকে সাড়া জাগানো নয়ক মান্না, রুবেল, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিল খান আর হাল আমলের শাকিবের কথাতো বলাই বাহুল্য। এ যেন এক প্রেমের কলেজ।
প্রেমিক-প্রেমিকার চাহনি, চোখের ইশারায় এরপরই রোমান্টিক গান। রিয়াজ ও শাবনূরের সেই গান ‘বুক ভরা ভালোবাসা/ রেখেছি তোমার জন্য/ ও প্রিয় আমার/ আমি যে তোমার/ গানটি কার না মনে আছে? হ্যাঁ এতক্ষণ যে কলেজের কথা বলা হচ্ছে সেটি হলো-এফডিসির সেই প্রতিকী কলেজ। যে ভবনের সামনে একে বেকে উঠেছে সিঁড়ি। আর এ সিঁড়িই বহু প্রেমের স্বাক্ষী। শুধুই কি প্রেম? এ প্রেম নিয়ে মারামারি কি কম হয়েছে? একটু ভাবুনতো সিনেমাপ্রেমী দর্শক? সবশেষ ফিরে যান আশি ও নব্বইয়ের দশকে। যখন দেশে সিনেমার রমরমা ব্যবসা। যে কোনো ছবি রিলিজ পেলেই হলগুলোতে পড়ত লম্বা লাইন। টিকিট না পেয়ে কত দর্শক যে হা পিত্যুষ করেছে এর ইয়াত্তা নেই। আর একদল ব্ল্যাকার ঘিরে রাখত হল। কান পাতলেই শোনা যেতো- ডিসি, রয়েল। লাগবনি ডিসি রয়েল? এসবই এখন ইতিহাস। বর্তমান সময়ে রাজধানী ঢাকার বহু সিনেমা হল উধাও হয়ে গেছে। হলের জায়গায় দেখা যাচ্ছে বিলাসবহুল মার্কেট। দিন দিন দর্শক হলবিমুখ হয়ে গেছে নানা কারণে। এরমধ্যে দেশের সিনেমা জগৎ যেমন দায়ী তেমনি দায়ী আকাশ সংস্কৃতি। তারপরও যে কটি সিনেমা বছরে তৈরি হয় তার বেশিরভাগ জোর করে রিলিজ দিতে হয় হলে হলে। এ অবস্থায় এখন সিনেমা জগতের চলছে দৈন্যদশা। একই সঙ্গে সেই কলেজেও এখন আর কেউ পড়তে যান না। হয় না প্রেমও। এফডিসির ৭ ও ৮ নাম্বার শুটিং ফ্লোরের পাশে ফাঁকা মাঠের ঘা ঘেষে দোতলা ভবনটিই ব্যবহার হয়েছে কলেজ হিসাবে। এর সামনে দিয়ে হেটে গেলে সব সময় লেগে থাকতো ভিড়। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট- এ শব্দে থমকে দাঁড়াতো এফডিসিতে আসা দর্শনার্থীরা। একনজর নায়ক-নায়িকাকে দেখতে অপেক্ষা করতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ ভবনে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট শব্দ এখন কালে ভদ্রেও শোনা যায় না। পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক, নায়িকা সেদিকে এখন পাও মাড়াননা । কালের স্বাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটি যেন এখনও ডাকছে। তাকে সরব করতে বোবা কান্না তার বুকে। স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে দিন রাত। চোখ বুঝে দেখছে এইতো সাইনবোর্ড বদল হচ্ছে। আজ এই কলেজ তো কাল ওই কলেজ। শুধু কি প্রেমই হয়েছে এখানে? কত নায়িকাকে যে খল নায়কের পাল্লায় পড়তে হয়েছে এ স্মৃতিওতো তার ঝুলিতে। এই যে দেখা যাচ্ছে শাবনূরের প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে ডন ঝাপিয়ে পড়েছে নায়িকার উপর। কত কসরৎ খল নায়কের। একবার যদি কাছে পাওয়া যায়। একবার যদি প্রতিশোধ নেয়া যায়? না প্রতিশোধ আর নেয়া হয়না। নায়ক এসে বাঁচিয়ে দেন নায়িকাকে। কলেজের ক্যাম্পাসে কত অপেক্ষা নায়ক কিংবা নায়িকার। দীর্ঘ অপেক্ষার পর নায়ক তার নায়িকাকে পেলেও এই কলেজ ভবনটি রয়েছে এখনো অপেক্ষায়। আবারও যেন শুনতে পাবে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। আবারও প্রাণ চাঞ্চল্যতা ফিরে আসবে এ ভবনকে ঘিরে। না! অপেক্ষা আর শেষ হয়না। দিন দিন অন্ধকার থেকে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছে সেখানে। তখনই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে কলেজ নামক ভবনটি। এখানে পা পড়েছে চলচ্চিত্রের বহুগুনী নির্মাতার। দিন-রাত বিভিন্ন সিনেমার দৃশ্যধারনের কাজ করেছেন তারা। কলেজকে ঘিরে বিভিন্ন দৃশ্য তুলে এনেছেন রুপালী পর্দায়। দর্শকদের চোখে সেই সব সিনেমার দৃশ্যগুলো যেন এখনো চোখে লেগে আছে। এই ভবনে কলেজ দেখানো হয়েছে শত শত সিনেমার। ৮০-৯০ দশকের বেশিরভাগ রোমান্টিক সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে এফডিসির এই কলেজ। প্রয়াত নির্মাতা মহম্মদ হান্নানের ‘বিক্ষোভ’ সিনেমার বেশকিছু অংশজুড়ে ছিল এফডিসির এই কলেজ। এ সিনেমায় অভিনয় করেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও শাবনূর। এফডিসির এই কলেজের শুটিং করার বিষয়ে শাবনূর বলেন, অনেক সিনেমায় এফডিসির সাজানো এই কলেজটি দেখানো হয়েছে। পাশে ছিল শহীদ মিনার। সবই মনে পড়ছে আজ। ‘বিক্ষোভ’ সিনেমায় ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়’ শিরোনামের গানটির দৃশ্যধারণ এখানে হয়েছিল। ছবির এ গানের নৃত্য পরিচালনা করেন মাসুম বাবুল। গানটি ও এফডিসির কলেজ প্রসঙ্গে জনপ্রিয় নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুল বলেন, তখন সময়ের মূল্যায়ন বেশি হতো। বিশেষ করে শুটিং সেটে সবার মাথায় থাকত যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দৃশ্যধারণ শেষ করতে হবে। তখন ব্যস্ত আর্টিস্ট ছিলো সালমান শাহ ও শাবনূর। তাদের শিডিউল মিলিয়ে কাজ করা হতো এবং ফিল্ম রিল দিয়ে শুট হতো সব দৃশ্যের। বাইরে শুটিং করতে গিয়ে সময়টা যেন মিসইউজ না হয় সে কথা ভেবে শুটিং হতো এই এফডিসির কলেজে। কারণ ইউনিটের সকলে মিলে প্রোডাকশনের খরচটাকে বেশ গুরুত্ব দিত, যেটা এখন নেই বললেই চলে। কলেজের দৃশ্যগুলো শুটিং করতেন নির্মাতারা। একটা টিমওয়ার্ক ছিলো। তাই কাজটিতে অতিরিক্ত কিছু খরচ হতো না। খুব কম সময়ে সীমিত বাজেটের মধ্যে ভালো ভালো সিনেমার কাজ হয়েছে এখানে। আর এখন তো রিল নেই, ডিজিটাল ফরম্যাটে শুটিং হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, আমার পরিচালিত ‘শান্ত কেনো মাস্তান’ সিনেমার শুটিং করেছিলাম এখানে। কলেজের দৃশ্য ছিল। মান্না অভিনয় করেছিল এ সিনেমায়। ছবিটি মুক্তির পর দারুণ ব্যবসাসফলতা পায়। এখানে চাইলে কলেজের দৃশ্যে বোঝাতে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বর্তমান সময়ের নির্মাতারাও শুটিং করতে পারেন। অনেকদিন ধরেই এই কলেজটি শুটিংহীন হয়ে পড়ে আছে। তবে জমে রেখেছে হাজারো ছবির স্মৃতি। চিত্রনাট্যকার আবদুল্লাহ জহির বাবু বলেন, আমার লেখা অনেক সিনেমার কাজ এখানে হয়েছে। বিশেষ করে একটা সিনেমার কথা আজ মনে পড়ছে। আমার বাবা জহিরুল হকের পরিচালনায় ‘সারেন্ডার’ ছবির শুটিং এখানে হয়েছিল। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন জসিম, শাবানা, বুলবুল আহমেদ। এছাড়া প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের কিছু সিনেমা, ছটকু আহমেদের ‘বুক ভরা ভালোবাসা’, কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’, মতিন রহমানের ‘নারীর মন’, শাহাদৎ হোসেন লিটন, এফ আই মানিকসহ অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা এফডিসির এই কলেজ অংশে শুটিং করেছেন। স্মৃতি হাতড়ে কলেজটি যেন আজও ডাকছে। বলছে, আমাকে ফের জাগিয়ে তুলুন। আমার ভালোবাসায় সিক্ত করতে চাই। নতুন প্রজন্মের নতুন হাতিয়ার নিয়ে ফের আমাকে তুলে ধরা হবে কোন সিনেমা কিংবা শর্টফিল্মে। এ অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হবে কলেজটির?