বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে ভুয়া ভিডিও ভারতে
ভারতের হিন্দুত্ববাদী একটি ফেসবুক পেজ থেকে এমন কয়েকটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে বৈধভাবে দিল্লিতে যাওয়া বাংলাদেশীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে।
ওই ভিডিওগুলো প্রায় এক কোটি আশি লাখ মানুষ দেখেছেন আর বিজেপি নেতারাসহ অনেক হিন্দুত্ববাদী ফেসবুক পেজ বা টুইটার হ্যান্ডেল থেকে সেগুলো শেয়ার করা হয়েছে।
ভারতে ভুয়া খবর খুঁজে বার করার ওয়েবসাইট অল্ট নিউজ খুঁজে বার করেছে ওই সব কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের কয়েকজনকে আর তারা যে বৈধ উপায়ে ভারতে বেড়াতে বা অন্য কাজে দিল্লিতে গিয়েছিলেন, সেই প্রমাণও বার করে এনেছে অল্ট নিউজ।
‘বর্তমান ভারত’ নামের একটি ফেসবুক পেজে আপলোড করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তি সাংবাদিকের মতো মাইক হাতে দিল্লির শাহিনবাগ এলাকায় মুসলমান দেখলেই জানতে চাইছেন যে তিনি কোথা থেকে এসেছেন। কীভাবে ভারতে এসেছেন? বিমানে না কাঁটাতার পেরিয়ে না পানি পথে”
প্রায় চার মিনিটের এ রকম একটি ভিডিওতে প্রায় ৩০ জনকে দেখানো হয়েছে, যারা প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে তারা বাংলাদেশী। তারা যে জুম্মার নামাজ পড়ে ফিরছেন, সেটাও জানিয়েছেন ওই বাংলাদেশীরা। তবে অনেকেই যে হিন্দিতে করা প্রশ্ন ঠিকমতো বুঝতে না পেরেই কোনোমতে জবাব দিচ্ছেন, সেটাও স্পষ্ট।
শুধু কোথা থেকে এসেছেন, সেটা জিজ্ঞাসা করেই ক্ষান্ত থাকেননি ওই ফেসবুক ভিডিওটির নির্মাতা। তিনি তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘কীভাবে ভারতে এসেছেন? বিমানে না কাঁটাতার পেরিয়ে না পানি পথে?’
কেউ যখন জবাব দিয়েছেন তারা আসলে মল্টার দূতাবাসে ভিসা নিতে এসেছেন, সেই জবাব এড়িয়ে গেছেন ওই ভিডিও নির্মাতা।
কাউকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে পয়সা, অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে ভারতে এসেছেন কি না। হিন্দি ঠিকমতো না বুঝে এক বাংলাদেশী জবাব দিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভিসার জন্য এসেছি।’ অর্থাৎ পয়সা (হিন্দিতে পইসা) কথাটাকে ওই বাংলাদেশী শুনেছেন ভিসা। কারণ ভিডিওতে এরপর তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ- ভিসা!’
অনেকেই বলেছেন যে ভিসার কাজ মিটে গেলে তারা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন।
দু’দিন ধরে এই সব ভিডিওগুলো আপলোড করার পরের দিন একটা দীর্ঘ ফেসবুক লাইভ হয়েছে ওই পেজ থেকে।
অল্ট নিউজের অনুসন্ধান
এই ভিডিও ব্যাপক ভাবে শেয়ার হতে দেখে সেটি নজরে আসে ভুয়া খবর ধরার ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের।
তারা যোগাযোগ করে এক স্থানীয় সাংবাদিক আরবাব আলির সাথে। তিনি জানিয়েছেন, যেসব বাংলাদেশীর চেহারা দেখানো হয়েছিল, তাদের তিনি কীভাবে খুঁজে বার করেছিলেন।
‘ভিডিওগুলো থেকে ৩০টিরও বেশি চেহারার স্ক্রিনশট নিয়ে আমি শাহিনবাগের বিভিন্ন মসজিদে ঘুরি। ইমাম, মুয়াজ্জিনদের সাথে কথা বলি। এ রকম চারটি মসজিদে ঘোরার পরে এক ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারি যে এই ব্যক্তিরা জুম্মার নামাজ পড়তে আসেন ঠিকই, কিন্তু প্রায় দু কিলোমিটার দূরের একটি এলাকায় থাকেন।
সেখানে গিয়ে এমন কয়েকজন বাংলাদেশীকে খুঁজে পান আরবাব আলি, যাদের ওই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল।
তিনি জানান, ‘প্রথমে ওই বাংলাদেশী নাগরিকরা তো কথাই বলতে চাননি। কারণ ততক্ষণে তারাও আগের ভিডিওটি দেখে ফেলেছিলেন এবং সেখানে যে তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটাও তারা জেনে গিয়েছিলেন।’
কয়েকজন বাংলাদেশীর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে আরবাব আলি বুঝতে পারেন যে কোনো প্রেক্ষিত না বলেই তাদের কাছে ওই ভিডিও নির্মাতা শুধু জানতে চেয়েছিলেন যে তারা কোথা থেকে এসেছেন।
ওই বাংলাদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে আলি জানতে পারেন যে, এদের একটা বড় অংশই এসেছেন মল্টায় যাওয়ার ভিসা নিতে।
বাংলাদেশে মল্টার কোনো দূতাবাস নেই, তাই বাংলাদেশীদের দিল্লিতে এসে মল্টার ভিসা নিতে হয়। আর ভারতেও তারা যে বৈধ ভিসা নিয়েই এসেছেন, সেই প্রমাণও দেখেছেন সাংবাদিক আরবাব আলি।
তাকে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী নাগরিক জানিয়েছেন যে ‘কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে না ওপর দিয়ে কীভাবে এসেছেন ভারতে?’ এই প্রশ্নে খুবই অপমানিত হয়েছেন তারা।
বিজেপির ভিডিওটি ব্যাপক শেয়ার
বহু পরিচিত বিজেপি নেতা নেত্রী এই ভিডিওগুলো শেয়ার করে নানা মন্তব্যও করেছেন।
কেউ লিখেছেন এদের ১০ থেকে ১৫ বছর জেলের সাজা হওয়া উচিত, কেউ এদের রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ করেছেন বা কেউ লিখেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালই এদের থাকতে দিচ্ছেন।
অল্ট নিউজের যে সাংবাদিক এই ভুয়া খবরের সত্যতা যাচাই করে একটি সংবাদ লিখেছেন, সেই অর্চিত মেহেতার নজরে পড়েছে যে ভিডিওগুলো শুধুমাত্র ফেসবুকেই দেয়া হয়েছে, ইউটিউব বা টুইটারে নয়।
‘একটা বিষয় খেয়াল করবেন যে ভিডিওগুলো কিন্তু শুধুই ফেসবুকে দেয়া হয়েছে। ইউটিউব বা টুইটারের মতো অন্য কোথাও নেই এটা। কারণটা স্পষ্ট-(হিন্দুত্ববাদী) ইকোসিস্টেমের সবথেকে বেশি ফলোয়ার ফেসবুকেই আছে। সব থেকে বেশিবার যাতে দেখা হয় আর শেয়ার হয়, সেজন্যই ফেসবুককে বেছে নেয়া হয়েছে,’ বলছিলেন অর্চিত মেহতা।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ভিডিওটির নির্মাতা সাংবাদিকের মতো করে ভক্সপপগুলো নিয়েছেন আর এটাকে একটা সংবাদ প্রতিবেদন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আবার হিন্দিতে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে, যে ভাষাটা বাংলাদেশীদের অনেকেই বুঝতেই পারেন নি।
‘এ ধরনের ভিডিওগুলো থেকে একটা প্যাটার্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে-আসলে এই শাহিনবাগ এলাকটিকে তো সেই নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদের পর থেকেই বারে বারে টার্গেট করা হয়ে আসছে। এখানেও সেটাই করা হয়েছে,’ বলেন বিশ্লেষণ অর্চিত মেহতার।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী ইকো সিস্টেম যাকে বলা হচ্ছে, সেটি হল আরএসএস বিজেপি আর সংঘ-ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলির অগণিত অনুগামী। যাদের মাধ্যমে যে কোনো খবর বা ছবিকে অল্প সময়ের মধ্যে ভাইরাল করে দেয়া হয়। বেশিরভাগ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক কোনো ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয় এই হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেম।
সূত্র : বিবিসি