পি কে হালদারকে কবে, কিভাবে ভারত থেকে দেশে আনা যাবে
হাজার হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদারকে (যিনি পি কে হালদার নামে বেশি পরিচিত) বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে আইনি পথেই দেশে ফেরানোর আশা করছে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। তবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে দেশে ফেরাতে অন্তত তিনমাস লাগতে পারে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা ধারণা করছেন। অবশ্য অবৈধভাবে নাগরিকত্ব নেয়ার অভিযোগে ভারতে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলে সেটি সময় সাপেক্ষও হয়ে উঠতে পারে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশের আর্থিক খাত থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর কয়েক বছর ধরে পলাতক ছিলেন পি কে হালদার। তবে শনিবার তাকে গ্রেফতার করে ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা দফতর। সেই সময় পি কে হালদারসহ ছয়জনকে আটক করা হয়, যার মধ্যে তার স্ত্রীও রয়েছেন।
ঢাকার একটি ব্যাংক ও অপর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পলাতক ছিলেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি মামলা করেছিলো। এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
‘দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি হবে’
পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
রোববার তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ফিনান্সিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশের সংস্থাগুলো কিন্তু তৎপর, সজাগ আছে। এজেন্সিগুলো কাজ করছে, আপনারা দেখবেন অচিরেই তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।’
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি অবৈধভাবে ভারতের পাসপোর্ট ও ভোটার আইডি কার্ড নিয়েছেন। ভারতের আইন অনুযায়ী এটি গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে ভারতে একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে?
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলছেন, ‘ভারতের আইনে জাল-জালিয়াতির কারণে তার বিচার হবে। সে মিথ্যা নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমাদের এখানে যে আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলাগুলো তো বিচারাধীন রয়ে গেছে। সেই মামলায় বিচারের জন্য তাকে আনতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আশাকরি দ্রুততার সাথে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’
শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির পাশাপাশি রোববার বাংলাদেশে বৌদ্ধ পূর্ণিমার সরকারি ছুটি থাকায় দফতরগুলো বন্ধ রয়েছে। ফলে পি কে হালদার গ্রেফতার হলেও সেই বিষয়ে এখনো বাংলাদেশে কোন কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। ‘আগামীকাল আশাকরি হয়তো এই বিষয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হবে।’ তিনি বলছেন।
রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এখনো আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্র আসেনি। পি কে হালদার আমাদের এখানে অনেকগুলো মামলার আসামি। আমরা ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছিলাম, সেটা আপনারা জানেন। অফিশিয়াল কাগজপত্র পাওয়ার পর আমরা আইনগত যে প্রচেষ্টা, সেটা অব্যাহত রাখবো।’
তিনি বলেছেন, ‘তিনি যেখানে আছেন, সেখানে তিনি কি করেছেন, সেই দেশের আইনের মুখোমুখি হচ্ছেন। আমরাও তাকে ফেরত চাইবো আমাদের দেশের মামলাগুলোর জন্য।’
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের আটই জানুয়ারি রেড নোটিশ জারি করেছিল ইন্টারপোল।
কিভাবে তাকে ফেরাতে পারে বাংলাদেশ?
ভারতের সাথে ২০১৩ সালে একটি বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তির আওতায় দুই দেশ বন্দী বিনিময় করে থাকে। এই চুক্তির স্বাক্ষরের পর ভারতের উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় আলোচিত নূর হোসেনকে এই আইনে ফিরে আনা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো অপরাধী আরেক দেশে লুকিয়ে থাকলে অথবা সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে থাকলে তাকে নিজ দেশে হস্তান্তর করা যাবে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে সেই দেশে কোনো মামলা বিচারাধীন থাকলে তাকে হস্তান্তর করার কোনো বিধান এই আইনে রাখা হয়নি।
বিবিসি বাংলার কলকাতা সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী জানাচ্ছেন, প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেফতারের পর অশোক নগরের স্থানীয় আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সেখানে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে থাকা মামলার বিবরণসহ ভারতে অর্থ পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা অমিতাভ ভট্টশালীকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার মামলাটি কলকাতার অর্থ পাচার আদালতে মামলা স্থানান্তর হবে। এরপর সেখানেই পি কে হালদারে বিচার কার্যক্রম চলবে।
ভারতে কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে অমিতাভ ভট্টশালী বলছেন, ‘সেখানে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আবেদন করা হতে পারে। আদালত তা গ্রহণ করলে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, যেভাবে এর আগে নূর হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছে।’
‘কিন্তু পি কে হালদারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় একটি ব্যাপার হলো, এই ব্যক্তি ভারতের গুরুতর আইন ভেঙ্গেছেন। তিনি বেআইনিভাবে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সেই কারণে যদি ভারতের কর্তৃপক্ষ আলাদা মামলা করে বিচার শুরু করে, তাহলে বিচার শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।’
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী, আটক থাকা অথবা কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের ফেরত পাঠানো যাবে। এক্ষেত্রে অন্তত এক বছর সাজা খাটতে হবে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, প্রক্রিয়া শেষ করে পি কে হালদারকে দেশে ফেরত আনতে তিন চার মাস লেগে যেতে পারে।
রোববার দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, আদালতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিন থেকে ছয়মাসের মধ্যে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা চলছে। ফলে তাকে এখনো ফেরত আনতে পারেনি বাংলাদেশ।
নিয়ম অনুযায়ী, বন্দী ফেরত আনতে হলে ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দীকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানানো হয়। এরপর আদালতের কাছে সেই বন্দীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি চাওয়া হয়। আদালত অনুমতি দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেই বন্দীকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির সাথে যোগাযোগ করে বৈঠকের মাধ্যমে বন্দী হস্তান্তর করে। বিজিবির কাছ থেকে ওই ব্যক্তিকে গ্রহণ করে আদালতে হাজির করে বিচারের মুখোমুখি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সূত্র : বিবিসি