করোনায় ত্রাণ বিতরণে ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল: টিআইবি
করোনা মহামারির সময়েও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) ‘করোনা সংকট মোকাবিলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের এ কথা জানানো হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর সময়ে গবেষণার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
অনলাইনে অনুষ্ঠিত গবেষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপক প্রফেসর ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশীজন হিসেবে বেসরকারি সংস্থাসমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তহবিল ও চলমান প্রকল্পের তহবিল ছাড়াও সাধারণ তহবিল থেকে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা, নগদ অর্থ বিতরণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান, মরদেহ দাফন ও সৎকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দিয়েছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো তুলনামূলক বেশি কার্যকর ছিল। নিয়মিত আয়ের উৎস না থাকা, দাতা সংস্থা কর্তৃক তহবিল হ্রাস এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় করোনা সংকট মোকাবিলায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর তহবিল সংকট ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে করোনা অতিমারির সময়েও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থার করোনা কর্মসূচি সংক্রান্ত তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ে তেমন কোনো অনিয়ম চিহ্নিত না হলেও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ঘাটতি ছিল। করোনাকালীন বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও বেশ কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে কিস্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া যায়। করোনাকালীন প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা দেখা গেলেও পরবর্তীতে স্বাস্থ্যসেবা, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সমন্বয়ের উন্নয়ন ঘটলেও বেসরকারি সংস্থা ও তদারকি সংস্থার অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
গবেষণায়, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশসমূহ হলো-
১. করোনাকালে তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের বিভিন্ন কার্যক্রমের (সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, নগদ অর্থ সহায়তা এবং ত্রাণ তৎপরতা) ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সমন্বয় সাধন করতে হবে।
২. বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক করোনাকালীন গৃহীত কর্মসূচির ধরন, আওতা, ব্যয়, উপকারভোগীর তথ্য ইত্যাদি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ ও নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করতে হবে।
৩. করোনাকালীন মাঠ পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রম বিশেষত উপকারভোগীদের ত্রাণ সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থা কর্তৃক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
৪. কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা নিরসনে তদারকি সংস্থা কর্তৃক উপকারভোগীদের তথ্য সংবলিত একটি সমন্বিত ডাটাবেজ ও ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করতে হবে।
৫. যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলায় সরকারকে শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব এনজিও নেটওয়ার্ক/প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গে নিয়ে একটি যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৬. করোনা সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর কর্মপরিকল্পনায় স্থানীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে এবং কর্মসূচিতে অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য জীবিকায়ন ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. বিভিন্ন দুর্যোগে বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সাড়াপ্রদান কার্যক্রম পরিচালনের জন্য সরকার কর্তৃক এবং দাতা সংস্থা কর্তৃক দুটি ভিন্ন তহবিল গঠন করতে হবে।
৮. বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বিবেচনায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে টিকা নিবন্ধন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
৯. আর্থিক ঝুঁকিতে পড়া স্থানীয় পর্যায়ের সংস্থাগুলোকে টিকে থাকার জন্য সরকার ও দাতা সংস্থা কর্তৃক নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
১০. ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে করোনাকালীন সংকট মোকাবিলায় সহজ শর্তে, স্বল্প সময়ে, কম সুদে ঋণপ্রাপ্তির ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা সদস্যদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বাজারজাতকরণের সুবিধা দিতে হবে।