চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে শুরু থেকেই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। চলতি বছরে কেবলমাত্র ইউপি নির্বাচনেই এ পর্যন্ত অন্তত ৯০ জনের বেশি মানুষ সহিংসতায় মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নির্বাচন ও রাজনীতির সংস্কৃতি বদলে গেছে। এখন রাজনীতি জনস্বার্থে হয় না, হয় ব্যক্তিস্বার্থে। এজন্য মারামারি, টাকা-পয়সা খরচ বা ভোট কেন্দ্র দখলসহ যেকোনো উপায়ে সবাই ক্ষমতায় থাকতে চায়।
এ কারণেই ঘটছে সহিংস ঘটনা। একই সঙ্গে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তারা। তাদের মতে, নির্বাচনে সহিংসতা বন্ধে যা করতে হবে তার সবই বিদ্যমান আইনেই দেওয়া আছে। কিন্তু সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। ফলে এ ধরনের ঘটনা দিনকে দিন আরও বাড়ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ৪৪২টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৮৭ জন। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজারের অধিক। এটা জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত হিসাবে। ডিসেম্বর মাস ধরলে এই সংখ্যা আরও বেশি। সর্বশেষ রোববার চতুর্থ ধাপের ভোটের দিন দেশে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা বন্ধে যা করতে হবে তার সবই আইনে দেওয়া আছে। নির্বাচন বন্ধ হতে পারে। যারা এগুলো (সহিংসতা) করবে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। কিন্তু এগুলোর কিছুই করা হয় না। নির্বাচন কমিশন এসব ঘটনা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, এটা (সহিংসতা) বন্ধ হচ্ছে না কারণ নির্বাচন কমিশন (ইসি) নজর দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। এ কারণে সহিংসতা বেড়েছে, বাড়ছে এবং বাড়বেই। এখানে পুরো সিস্টেমে গণ্ডগোল আছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না কারণ পুরো নির্বাচন ও রাজনীতির সংস্কৃতি আমরা বদলে দিয়েছি। এখন আর জনকল্যাণের জন্য কেউ রাজনীতি করে না। এটাকে ব্যবসা হিসাবে নেওয়া হয়। তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে টাকা আয় করতে চান। এজন্য তারা মারামারি, টাকা-পয়সা খরচ, ভোট কেন্দ্র দখলসহ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে চান। এটা আমাদের রাজনৈতিক ও নির্বাচনি সংস্কৃতির একটা বড় ধরনের অবক্ষয়। তিনি আরও বলেন, এটা রোধ করতে পারে রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচন কমিশন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা বড় রোল আছে। তারা সবাই মিলে যদি চান তাহলে এটা অবশ্যই বন্ধ হবে। সবার সদিচ্ছা থাকলে এটা খুব কঠিন কাজ নয়।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মূল সমস্যা হলো আমরা রোগের উপসর্গ নিয়ে আছি। মূল রোগ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করছি না। সহিংসতা হলো উপসর্গ। মূল রোগ হলো আমাদের রাজনীতির অবক্ষয়। রাজনীতি এখানেই বন্দি থাকলে এটা থেকে মুক্তি সম্ভব না। তিনি বলেন, এগুলো বন্ধ করতে হলে রাজনীতি কলুষমুক্ত করতে হবে। রাজনীতি যে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে তার অবসান ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে কেউ যেন অন্যায় করে পার পেয়ে না যায় সেজন্য নির্বাচন কমিশনসহ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের কার্যকারিতা আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে এগুলো থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব না।