এরদোগানের বছর
বিদায়ী বছরটি ছিল তুরস্কের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের বছর। গেল বছর তুরস্ক বহু বড় ঘটনারও প্রত্যক্ষদর্শী। দেশটির পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। কয়েক বছর ধরে এই গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়াও ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের চলমান বিরোধ, তুরস্ক-আমেরিকার সম্পর্কের উত্থান-পতন এবং লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় আঙ্কারার সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল আলোচিত ঘটনা।
২০১৯ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল তিউনিসিয়া সফর। দেশটির পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতির আলোকে তিনি অঘোষিতভাবে এবং অনেকটা আকস্মিকভাবে তিউনিসিয়া সফর করেন এবং তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। লিবিয়ার চলমান যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত সমাধানের পথ অনুসন্ধানের জন্যই এরদোগান এই সফর করেছেন বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।
গত অক্টোবরে সাঈদ নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই তুরস্কের পক্ষ থেকে প্রথম তিউনিসিয়া সফর। গত ২৭ নভেম্বর তুরস্ক ও লিবিয়া দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার পর তিউনিসিয়ায় তুর্কি প্রেসিডেন্ট এই সফরে গেলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লিবিয়ার সাথে সমঝোতা স্মারক তথা চুক্তি স্বাক্ষর করার পর ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল এবং লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ উভয়টির দৃশ্যপট তথা ভারসাম্য পাল্টে গেছে।
উভয় দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তির পর এরদোগান বলেছেন, ত্রিপোলি অনুরোধ করলে আঙ্কারা লিবিয়ায় সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। তিনি তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদের সাথে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘লিবিয়া আমন্ত্রণ জানালে আমরা সেটা মূল্যায়ন করব।’ এরদোগান আরো উল্লেখ করেন, তুরস্ক ও লিবিয়া সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। আর এ ব্যাপারে গ্রিসের মন্তব্য করার কোনো অধিকার নেই।
লিবিয়া ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা যখন চরম পর্যায়ে রয়েছে এমনই একসময়ে চলতি জানুয়ারি মাসেই বার্লিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরদোগান বলেছেন, এই সম্মেলনে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ লিবিয়া সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে এ দু’টি দেশেরও বক্তব্য থাকা উচিত। এ দু’টি দেশের দোরগোড়ায় এই সঙ্ঘাত চলার কারণে দু’টি দেশের পরামর্শ ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধ-সঙ্ঘাতের কারণে দু’টি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সামাজিক-রাজনৈতিক গঠন ও দৃশ্যপট সম্পর্কেও দেশ দু’টি ভালোভাবে অবগত রয়েছে। আমরা জানি, লিবীয় সঙ্ঘাত নিরসনের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বার্লিন শান্তিপ্রক্রিয়া নামে জার্মানির রাজধানীতে উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে তুরস্ক বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। সিরিয়া শরণার্থীদের তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে, দায়েস যোদ্ধাদের তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দিদের হুমকি মোকাবেলায় তুরস্ক সাহসী ও সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর ৯ অক্টোবর তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অপারেশন পিস স্প্রিং নামক সামরিক অভিযান শুরু করে।
তুরস্ক সিরিয়া অভিযান শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সোচিতে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসার জন্য এরদোগানকে অনুরোধ জানান এবং বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প এরদোগানের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। আঙ্কারা রাশিয়ার এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয় এবং ন্যাটোর সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতির বিষয়টিও গত বছর ধরে আলোচনায় ছিল। অদূর ভবিষ্যতেও এই দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।
সুতরাং তুরস্কের জন্য ২০২০ সালে কী ঘটতে যাচ্ছে? সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের চলমান বিরোধ, লিবিয়ায় তুরস্কের সম্ভাব্য সৈন্য মোতায়েন এবং পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ইত্যাদি অব্যাহত থাকতে পারে।
আগামী ৮ জানুয়ারি চলতি বছরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য এই বৈঠক উপলক্ষে পুতিন তুরস্ক সফর করবেন বলে নির্ধারিত রয়েছে। পুতিনের তুর্কি প্রতিপক্ষ এরদোগান তাকে তুরস্কে স্বাগত জানাবেন। ইস্তাম্বুলে টার্কস্ট্রিম প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন প্রজেক্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুতিন যোগ দেবেন। এ সময় প্রতিবেশী অন্য দেশের নেতারাও উপস্থিত থাকবেন। উল্লেখ্য, কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করে গেছে রুশ-তুর্কি পাইপ লাইনটি। এই প্রকল্পটিকে তুরস্ক ও রাশিয়ার একটি কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উভয় দেশ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা জোরদার করেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জানুয়ারি মাসে তুরস্ক সফর করবেন। এই সফরে আঙ্কারা-জার্মান সম্পর্ক এবং আঙ্কারা-ইইউ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। চলতি বছর আঙ্কারা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নিঃসন্দেহে আঙ্কারা তাদের এজেন্ডায় পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা নীতিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবে। তুরস্কের কূটনৈতিক ও সামরিক সাফল্য বা অর্জন চলতি বছরও অব্যাহত থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।