শিশু নির্যাতনকারীদের কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন?
পরিবার, সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বা খবর গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহই ঘটতে দেখা যায়। এসব শিশু নির্যাতন কী ধরণের অপরাধ? এ অপরাধ কি আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন? এ সম্পর্কে ধর্মীয় নির্দেশনাই বা কী? বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার আল্লামা তকি উসমানি এ সম্পর্কে তুলে ধরেছেন গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
তিনি বলেন, হজরত আশরাফ আলি থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কখনও শিশুকে মারবে না। বাবা-মা শিক্ষকদের জন্যও এ একই কথা। রাগ কমে যাওয়ার পর চিন্তা-ভাবনা করে শিশুদের উপযোগী শাস্তি দেয়া। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শিশু ছাত্র-ছাত্রীদের উত্তম শাস্তি হলো- ছুটি মাফ করে দেয়া। শিশুর উপর এর খুব প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।
মিয়াজি (শিক্ষকরা) সাধারণত ছাত্রদের শাস্তি (মার-ধর) দিতে এ জন্য স্বাধীন হয়ে যান যে, তাকে প্রশ্ন করার কেউ থাকে না। কেননা শিশুর তো শিক্ষকের সামনে প্রশ্ন করার সাহস বা যোগ্যতা কোনোটিই নেই। আর অভিভাবক মিয়াজীকে (শিক্ষক) এই বলে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন যে- ‘হাড্ডি আমাদের, আর চামড়া মিয়াজীর’!
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি-
যার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করার কেউ থাকে না তার সম্পর্কে প্রশ্নকারী স্বয়ং আল্লাহ। এমনকি কোনো জিম্মী (মুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিক, যার নিরাপত্তা মুসলিম শাসকের জিম্মায়) কাফেরের উপর যদি কোনো শাসক জুলুম করে তাহলে হাদিস শরিফে এসেছে যে- ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’ (আনফাসে ঈসা)
সুতরাং কোমলমতি শিশুদের প্রতি বিবেকহীনভাবে মারধর কিংবা শারীরিক অত্যাচার-নির্যাতন মারাত্মক ভয়াবহ অপরাধ। শিশুদের প্রতি প্রহার করলে আল্লাহ তাআলা এ অপরাধের গোনাহ ক্ষমা করবেন না।
এ কারণে মুফতি শফি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, মানুষের অন্যান্য গোনাহ তো তওবার মাধ্যমে ক্ষমা হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করার গোনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়া খুবই দুষ্কর। কারণ এটা বান্দার হকের সঙ্গে শামিল। আর বান্দার হক শুধু তাওবাহ দ্বারা ক্ষমা হয় না। বরং যার হক নষ্ট হয়েছে কিংবা যে শিশু জুলুমের শিকার হয়েছে, সে শিশুকে ক্ষমা করতে হবে।
আর যে শিশুর উপর মারধর তথা জুলুম করা হয়, সে শিশু যদি নাবেল বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয়। তবে নাবালেগের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি কোনো নাবালেগ শিশু যদি মুখে বলে যে- ‘আমি আমার শিক্ষক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছি বা আমি মাফ করলাম, শিশু নাবালেগ হওয়ার কারণে তার এ কথাও গ্রহণযোগ্য হবে না।
সুতরাং পারিবার, সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠানে যাদের দায়িত্বে নাবালেগ শিশু রয়েছে, তাদের উচিত, শিশুদের প্রতি কোমল আচরণ করা। শিশুদের সঙ্গে খারাপ আচরণে সাবধানতা অবলম্বন করা।
এ কথা ঠিক যে-
শিশুদের পড়ালেখা করানো অনেক কঠিক কাজ। শিশুদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব সহজ নয়। তাই কখনও কখনও মারধরের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। সে কারণেই এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতি মাথা গরম করে শাস্তি দেয়া ঠিক নয়। বরং এ সময় চুপ থাকা। রাগ দূরভীত করা। তারপর যখন মাথা ঠাণ্ডা হয় কিংবা পরিস্থিতি শান্ত হয় তখন চিন্তা-ভাবনা করে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
শিক্ষা কিংবা কাজের পরিবেশে ভারসাম্য ঠিক রাখতে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে তাও এমনভাবে দেয়া যাতে সেটা শিশুর জন্য ক্ষতি কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম না হয়। এ কারণেই তাকে শারীরিক শাস্তি প্রয়োগ না করে এমন হালকা শাস্তি দেয়া যাতে তার মাঝে অপরাধ প্রবনতা কমে আসতে মানসিক চিন্তা-ভাবনার সুযোগ ঘটে।
রাগের মাথায় শিশুদের প্রতি শান্ত না থেকে অধৈর্য হয়ে যদি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক থাপ্পড়ের কাজে দশ থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কিংবা হালকা এক-দুটো বেত্রাঘাতের পরিবর্তে অসংখ বেত্রাঘাত বসিয়ে দেয় তবে তা হবে হিতে বিপরীত। অর্থাৎ দায়িত্বশীলের এমন আচরণে ওই ব্যক্তি গোনাহগার হবে। আর শিশুও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আর সামাজিকভাবেও তাকে বিচারের মুখোমুখি কিংবা হেয় হতে হবে।
এ কারণেই হজরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নিয়ম করেছিলেন যে-
‘মকতবে কোনো হুজুর বা শিক্ষক শিশুদের মারধর করতে পারবে না। কেউ তা করলে তাকে জবাবদিহি করতে হত এবং কখনও কখনও উল্টো শিক্ষককে শাস্তিও পেতে হতো।‘
একবার তিনি একথাও বলেছিলেন যে-
যদি জানা যায় যে, কোনো কারী সাহেব বা হুজুর কোনো শিশুকে মেরেছে তাহলে ওই কারী সাহেবকে মসজিদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে ওই শিশুর দ্বারা উল্টো বেত্রাঘাত করানো হবে। শিশুদের প্রতি মারধরের বিষয়টি খুবই নাজুক ও মারাত্মক। সে কারণেই আশরাফ আলি থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ বিষয়টি সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর হয়েছিলেন।
সুতরাং পারিবারিক, সামাজিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বশীলদের ব্যাপারেও এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য যে, কোনো শিশুকে মারধর করা নয়, বরং তাকে ইতিবাচক মানসিকতায় লালন-পালন করা। রাগের মাথায় শিশুর প্রতি অত্যাচার না করে শালীন ও মার্জিত উপায়ে হালকা শাস্তি কিংবা মানসিক পরিবর্তনে সহায়ক কাজ করা।
যেহেতু আল্লাহ তাআলা শিশুর প্রতি অন্যায় আচরণের বিষয়টি ক্ষমা করবেন না সেহেতু শিশুর প্রতি মানবিক হওয়ার বিকল্প নেই। তাই রাগের মাথায় শিশুর প্রতি অমানবিক আচরণ না করে ঠাণ্ডা মাথায় ইতিবাচক আচরণ করাই শ্রেয়।