তবে কি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি’র নিয়ন্ত্রণেই যাচ্ছে?

0

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের দেশের মত দলবদল চলছে। এই দলবদলের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দলবদলের মিল রয়েছে। এরা ক্ষমতার স্বাদের জন্য দল বদল করে; যেমনটা করেছেন আমাদের দেশের এক কালের সব বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী পণ্ডিতেরা।

‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার এই অংশটি পড়তে গিয়েই মনে পড়ে গেল, পশ্চিমবাংলার নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনের জয়ের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে মমতা ব্যানার্জীর দল তৃণমূল কংগ্রেস। হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থনপুষ্ট ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি’র গেরুয়া পোশাক গায়ে চাপিয়ে তৃনমূল কংগ্রেস থেকে ঝরে পড়েছে বহু নেতাকর্মী।

বাংলায় এখন রবীন্দ্র, নেতাজী সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দ চর্চা এমনকি সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে বাংলার নির্বাচনের আগে মোদিজীর চেহারার ভূষণ-ভাষণও অনেকটা রবীন্দ্র আকার ধারণ করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে রবীন্দ্রনাথকে পিন্ডি চটকানো হচ্ছে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে রবীন্দ্রনাথের রচিত ভারতের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি উঠছে। এমন দাবি তুলছেন বিজেপি নেতা রাজ্যসভার সদস্য সুব্রামনিয়াম, এ দাবির পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন মোদিজি নিজেই।

বাংলার রাজনীতিতে স্বামী বিবেকানন্দ সর্বকালের সর্বজন স্বীকৃত মানব। স্বামীজীর জন্মদিন ঘিরে ধুমধাম করে মিছিল করছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো এক ধাপ এগিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, বঙ্গে পরিবর্তনের জন্য বিবেকানন্দই তাঁদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যা দেখে তৃণমূল নেতৃত্বের খোঁচা, ভোট আসছে বলে বিবেকানন্দের কথা এখন ওদের মনে পড়ছে। আর বামেদের মতে, বিজেপি বিবেকানন্দের ধর্ম সংক্রান্ত ধারণাটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে। সব দলের পক্ষ থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হলেও অতীত বছরগুলোতে এমন উদযাপনের করার নজির কম।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের দেশের মত দলবদল চলছে। এই দলবদলের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দলবদলের মিল রয়েছে। এরা ক্ষমতার স্বাদের জন্য দল বদল করে; যেমনটা করেছেন আমাদের দেশের এক কালের সব বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী পণ্ডিতেরা। তারা এখন সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে দেশ চালাচ্ছেন। তেমনি ভারতের সেই ৩৪ বছরের বামপন্থী শাসনের অনেক নেতা এখন বিজেপির কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা দেখছেন সামনে হয়তো বিজেপি ক্ষমতায় আসবে। গত লোকসভা নির্বাচনের ভোটের সমীক্ষা ভোটের ফলাফলে অন্তত তাই দেখা গেছে। সেখানে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের পার্থক্য ছিল খুবই সামান্য। গত লোকসভা নির্বাচনে এই দুই দলের আসন সংখ্যার পার্থক্য ছিল মাত্র ৪টি।

তৃণমূল কংগ্রেস কোন রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান এসেছিল বাম শাসনের ব্যর্থতাকে সামনে তুলে ধরে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সিঙ্গুর ভূমি অধিগ্রহণের ঘটনা। সিঙ্গুরে সেই সময় ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট শিল্পকারখানা করার জন্য প্রথম দফায় কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটার নামে বরাদ্দ দেয়। দ্বিতীয় দফায় টাটার‌ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এসব কিছুকে হাতিয়ার করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সিঙ্গুর এলাকাতে আশেপাশে গুলোতে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের বসবাস। সেই কৃষকদের সমর্থন আদায়ের  লক্ষ্যেই সিঙ্গুর কাণ্ড ঘটিয়েছিল তৃণমূল। সিঙ্গুর কাণ্ডের ক্ষত আজও পশ্চিমবাংলা বয়ে নিয়ে চলছে। আজ পশ্চিমবাংলায় শিল্প বিনিয়োগ কোন গতি পায়নি, এমনকি রাজ্য হিসাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ও পিছিয়ে পড়া একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। আর এর পুরোটাই হচ্ছে বিভাজিত বাংলার একদিকে ধর্মীয় বিভাজন অন্যদিকে রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে। পশ্চিম বাংলায় বামেরা এখনো মানুষকে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায়। যে সমাজতন্ত্র পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সেই সমাজতন্ত্রের গল্প শুনিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামেরা প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রে বিজেপি কে ক্ষমতায়নে সহায়তা করেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতা যখন চালাচ্ছিল বামেরা সেই সময় পারমাণবিক চুক্তি সংক্রান্ত এক মতদ্বৈততার কারণে বামেরা জোট ত্যাগ করে। তখন লোকসভার স্পিকার ছিলেন সোমনাথ চ্যাটার্জি। দুঃখের বিষয় সোমনাথ বাবুর মত একজন আপাদমস্তক বাম রাজনীতির ধারককে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল বামেরা। কারণ বামদের নির্দেশে সোমনাথ বাবু স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন নাই। সোমনাথ বাবুর যুক্তি ছিল, তিনি পার্লামেন্টের স্পিকার, তিনি কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না। যার ফলে পরবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়, বিজেপি ক্ষমতায় আসে। পশ্চিম বাংলার বামেরা সেই একই ধরনের কাজ এখনো করে চলছে। বিজেপিকে প্রধান শত্রু ভাবার পরিবর্তে তারা তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। সেই পুরনো কংগ্রেসের সঙ্গে পশ্চিমবাংলায় হাত মেলাচ্ছে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট। উভয়ের জায়গা থেকে নেতারা ভেড়ার পালের মতন বিজেপিতে যোগদান করছেন। মমতা ব্যানার্জির অক্ষমতার ফলে তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করছেন তার শক্তিশালী অনুরাগীরা। তৃণমূল কংগ্রেস মানেই মমতা ব্যানার্জি; মমতা ব্যানার্জির বাইরে তৃণমূল কংগ্রেস বলতে কিছু নাই। সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যার ভাতিজার বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার প্রচলিত শব্দ ‘তোলাবাজির’ অভিযোগ বিদ্যমান।

পশ্চিমবাংলার আসন্ন নির্বাচনে কে জয়লাভ করবে তা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাবে মনে হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, যে হিন্দু মহাসভার গর্ভ থেকে বিজেপির জন্ম। তারপরও বিজেপির বহু বছর অপেক্ষা করতে হল পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসতে। তার শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হয়তো বাম কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে কার বিভাজনে বিজেপিকে শক্তিশালী করছে।

পশ্চিমবাংলার আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য পশ্চিমবাংলার এই তিনটি দল কোন নির্বাচনী সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারে। তবে বিজেপির বিজয় অবশ্যম্ভাবী, মমতা ব্যানার্জি বিজেপির বি টিম হিসেবে কাজ করছে বহুদিন। বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি আটকে দেওয়া কিংবা সীমান্তে হত্যার ঘটনায় কখনো মমতা কিংবা পশ্চিমবাংলার অন্যান্য দল বিরোধিতা করেনি। পশ্চিমবাংলা রাজনীতিতে একটি বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের গল্প। এই গল্পে সমানভাবে উচ্চারণ করে বাম কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি। কিন্তু একথা ভেবে দেখেনা পশ্চিমবাংলার রাজ্যটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশের এক ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বিরাট ভূমিকা আছে। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর পশ্চিমবাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পশ্চিমবাংলার চিকিৎসাব্যবস্থা আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সেখানে চিকিৎসা করানোর মাধ্যমে। প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক কেন্দ্রের বজায় আছে তা বিজেপি সরকার যদি পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসে তাহলে তা কতটুকু টিকে থাকবে সে প্রশ্ন করা যায়। একথা অবশ্যই সত্য বিজিপি ক্ষমতায় আসলে ভারতের সিএএ-এনআরসি দুটোই ভারতের পশ্চিমবাংলায় বাস্তবায়ন করবে বিজেপি এবং সে ঘোষণা বিজেপির মন্ত্রী অমিত শাহ অলরেডি প্রদান করেছেন।

আগামী ২৪ জানুয়ারি ভারতের নির্বাচনী ফলাফল যাচাই-বাছাই জন্য  নির্বাচনী সমীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মনে করা হচ্ছে বিজেপির পক্ষেই যাবে সমীক্ষার ফল। পশ্চিমবাংলা রাজনীতি বিজেপি কে পরাস্ত করতে পারে একমাত্র তৃণমূল বাম ও কংগ্রেসের জোট বদ্ধ নির্বাচন। আর না হলে বিজেপির কাছে তৃণমূলের পরাজয় হবে। আরো উল্লেখযোগ্য যে সর্বভারতীয় জামাত ইসলামী হিন্দ নামক যে রাজনৈতিক দল নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী দীর্ঘদিন তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রিসভার সদস্য তার দল তৃণমূল  কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে এবং ধারণা করা হচ্ছে বিজেপির সঙ্গে তারও সম্ভবত একটি সমঝোতা হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com