অগ্নিগর্ভ নেপালে চীন ও ভারতের লাভ-ক্ষতির সমীকরণ

0

নেপালে গত ২০ ডিসেম্বর হঠাৎ পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার যে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কে পি অলির বিরোধীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে, তার বৈধতা নির্ধারণে বুধবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুরু কথা।

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ১২টির মতো আবেদন হয়েছে। আবেদনগুলোতে অভিযোগ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে সংশোধিত সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।

ধারণা করা হচ্ছে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট হয়তো দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কিন্তু আদালতের রায়ে কী সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে?

অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নেপালে নতুন একটি রাজনৈতিক সঙ্কটের যে সূচনা হয়েছে, আদালতের রায়ে তার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কাঠমান্ডুতে সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক কমল দেব ভট্টরাই মনে করেন, ২০১৭ সাল থেকে গত তিন বছর ধরে নেপালের সরকার এবং রাজনীতিতে বিরল যে স্থিতিশীলতা চলছিল সংসদ ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তে তা ব্যাপক হুমকিতে পড়েছে।

বিশ্লেষক কমল দেব ভট্টরাই গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে এখনই তা বলা মুশকিল, কিন্তু নেপাল যে আবারো নতুন একটি অস্থিতিশীল রাজনীতির আবর্তে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আদালত যে রায়ই দিক না কেন তাতে এই সঙ্কটের সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।’

কমল দেব ভট্টরাই বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যদি কে পি অলির সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেয়, তাহলে তার নিজের দল নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বড় একটি অংশ এবং প্রধান বিরোধী দলগুলো হয়তো মধ্যবর্তী নির্বাচন বয়কট করবে। আর যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে কে পি অলির বিরুদ্ধে তার নিজের দলের একটি অংশই হয়তো অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে। সুতরাং রায় যেটাই হোক হোক না কেন সঙ্কট তাতে মিটবে বলে আমি মনে করি না।’

ক্ষমতাসীন দলে ভাঙন
নেপালের নতুন এই রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব যা সাম্প্রতিক সময়ে চরমে পৌঁছেছে।

কমল দেব ভট্টরাই মনে করেন, ‘আপনি এখন পরিষ্কার বলতে পারেন নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি ভেঙে গেছে। মীমাংসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে সঙ্কটের আশু মীমাংসাও এখন সম্ভব নয়।’

নেপালের প্রধান যে দুই মাওবাদী দল সশস্ত্র আন্দোলন করে রাজতন্ত্র উৎখাত করেছিল এবং পরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করে, তারাই এখন পরস্পরের প্রধান বৈরি হয়ে উঠেছে।

দু’হাজার সতের সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কে পি অলির দল সিপিএন-ইউএমএল এবং পুস্পা পছন্দ কমল দাহালের সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার) একটি নির্বাচনী মোর্চা তৈরি করে।

২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে কে পি অলির দল সবচেয়ে বেশি ১২১টি আসন জিতলে পুষ্পা দাহালের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। পরপরই মূলত চীনের চেষ্টায় এই দুই মাওবাদী দল একত্রিত হয়ে নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিএন) নামে অভিন্ন দল তৈরি করে।

অলি ও দাহালের মধ্যে তখন চুক্তি হয় দলে এবং সরকারে তাদের ক্ষমতা সমানভাবে ভাগাভাগি হবে। কিন্তু দাহাল, যিনি প্রচন্দ নামে বেশি পরিচিত। বেশ কিছু দিন ধরে অভিযোগ করছেন, অলি তার কথা রাখেননি। দল ও সরকারে একচ্ছত্র প্রাধান্য তৈরির চেষ্টা করছেন।

অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা করছেন, দাহাল ও তার অনুগতরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই প্রধানমন্ত্রী অলি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন।

সংসদ ভেঙে দেয়ার বিরুদ্ধে গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানী কাঠমান্ডু ছাড়াও নেপালের অন্যত্র হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে মিছিল ও সমাবেশ করছে।

রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা বা নেপালকে আবারো হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার পক্ষের দল এবং গোষ্ঠীগুলোও এই সুযোগে সরব হয়েছে। তারাও এখন নতুন করে বিক্ষোভ জমায়েত করছে।

চীনের উদ্বেগ
নেপালে এই অস্থিরতার দিকে নেপালিদের যতটা নজর তাদের যতটা উদ্বেগ, প্রতিবেশী দুই জায়ান্ট চীন ও ভারতের নজর-আগ্রহ তার বেশি ছাড়া কম নয়।

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, মূলত তিব্বতের কারণে চীনের কাছে নেপালের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। ভারতের সাথে ক্রমবর্ধমান বৈরিতার প্রেক্ষাপটে সেই গুরুত্ব বেড়েছে।

পঞ্চাশের দশকের পর তিব্বতি বিদ্রোহীরা নেপালে আশ্রয় নিয়ে অনকে বছর ধরে চীন বিরোধী তৎপরতা চালিয়েছে। চীন কোনোভাবেই চায়না নেপালের ভূমি আর কখনো চীন বিরোধী তৎপরতার জন্য ব্যবহার করা হোক।

ড: মাহমুদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত বছরগুলোতে চীন যেভাবে নেপালে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে, কোনোভাবেই তা তারা নষ্ট করতে চাইবে না। নেপালে নতুন অবকাঠামোর প্রায় সবগুলোই এখন চীনের পয়সায় হচ্ছে।’

ওই কারণেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী উপ-মন্ত্রী গুও ইঝাও, যিনি দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দেখেন, ২৭ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুতে এসে কম্যুনিস্ট পার্টির দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে মীমাংসার একটি চেষ্টা করেন।

চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির এই নেতাই ২০১৭ সালে নেপালের মাওবাদী দুই দলের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু এ দফায় বিরোধ মেটাতে কোনো সাফল্য তিনি যে পেয়েছেন তার কোনো ইঙ্গিত নেই।

কমল দেব ভট্টরাই বলেন, কম্যুনিস্ট পার্টির দুই প্রধান নেতার মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে তা সহজে মেটার নয়।

ড: মাহমুদ আলী মনে করেন, ‘নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টিতে এই ভাঙন চীনের জন্য বড় একটি ধাক্কা। চীনই দুটি মাওবাদী দলকে একত্রিত করে ক্ষমতা নিতে সাহায্য করেছিল। এটা চীনের জন্য বড় একটি রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতা নেয়ায় গত কয়েক বছরে নেপালে প্রাধান্য বিস্তারে অনেক সুবিধা চীনের হয়েছে। দলে ভাঙনে ওই সাফল্য অনেকটাই হুমকিতে পড়বে সন্দেহ নেই।’

কিন্তু চীনের সামনে এখন বিকল্প কী?
ড: মাহমুদ আলী বলেন, ‘কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতা হারালে যে দল বা জোট পরবর্তীতে নেপালের ক্ষমতায় আসুক তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে চীন। চীনের সরকার এখন যতটা বাস্তববাদী ততটা আদর্শিক নয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তারা যেকোনো সরকারের সাথে সম্পর্কে প্রস্তুত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশেগুলোতেও তারা তাই করছে।’

অস্থির নেপালে ভারতের অঙ্ক
নেপালের নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে দিল্লিতে মোদি সরকার নিশ্চুপ, কিন্তু ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টিতে ফাটলে ভারত যে খুশী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নিরাপত্তা ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে যে প্রতিবেশী দেশটির গুরুত্ব ভারতের কাছে অনেক, গত কয়েক বছরে তার সাথে সম্পর্ক ক্রমেই নষ্ট হয়েছে। একই সাথে ভারতের বৈরি একটি দেশের সাথে নেপালের সম্পর্ক ক্রমে উষ্ণ হয়েছে।

দিল্লিতে জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড: সঞ্জয় ভরদোয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত মনে করে কে পি অলির কম্যুনিস্ট সরকারের কারণেই নেপালের সাথে এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কে পি অলি ২০১৫ সালে সীমান্ত অবরোধের সূত্র ধরে তখন থেকে নেপালে ভারত বিরোধী মনোভাব উসকে দিয়ে চলেছেন। সুতরাং অলি ক্ষমতা হারালে এবং তার দলে ভাঙন হলে ভারত খুশি।

নেপালের নতুন যে মানচিত্র সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কে পি অলির সরকার সেখানে ভারত নিয়ন্ত্রিত বেশ বড় একটি এলাকাকে নেপালের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক নাখোশ ভারত।

ড: ভরদোয়াজ বলেন, ‘ভারত চাইবে কম্যুনিস্ট পার্টির বদলে নেপালি কংগ্রেসের মতো গণতান্ত্রিক কোনো দল বা সমমনা দলগুলোর মোর্চা নেপালে ক্ষমতায় আসুক। এমনকি পছন্দ কম্যুনিস্ট হলেও ভারতের ব্যাপারে অনেক সহনশীল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দু’বার ভারত সফর করেছেন। আমি মনে করি ভারত বিশেষভাবে চায় অলি যেন নেপালে ক্ষমতায় না থাকেন।’

অর্থনৈতিক স্বার্থ এক নম্বর স্বার্থ
নেপালে কে পি অলির সরকার ক্ষমতা হারালে বা কম্যুনিস্টরা ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও কী নেপাল থেকে চীনকে পাততাড়ি গোটাতে হবে?

কমল দেব ভট্টরাই বলেন, ‘তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ যে এক নম্বর স্বার্থ তা নিয়ে নতুন সংবিধান তৈরির সময় থেকেই এক ধরনের ঐক্যমত্য নেপালের রাজনৈতিক এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হয়েছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও ওই ঐক্যমত্য ভেঙে পড়বে বলে আমার মনে হয় না। তাই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদল নেপালের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে গেছে। সন্দেহ নেই চীন নেপালের ক্ষমতায় কম্যুনিস্টদের চায় ও চাইবে, কিন্তু নেপালি কংগ্রেসের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ- এ কথা বলা যাবে না। কাঠমান্ডুর ক্ষমতায় এখন যারাই আসুন, চীনের লম্বা পকেট অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে।’

সূত্র : বিবিসি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com