ফিলিপাইনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হয়েছে : আইসিসি প্রসিকিউটর

0

প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের মাদকের বিরুদ্ধে তথাকথিত যুদ্ধে ফিলিপাইন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এটা ‘বিশ্বাসের যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) চিফ প্রসিকিউটর।

সোমবার আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতু বেনসোদার কার্যালয় বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুরুতর শারীরিক আঘাত ও মানসিক নির্যাতন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চের মধ্যে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে।

আইসিসির কৌঁসুলির কার্যালয়টি ২০১৮ সাল থেকে ফিলিপাইনের মামলাটি খতিয়ে দেখছে। এটি বিশেষভাবে যে অভিযোগের ব্যাপারে কাজ করেছে তা হলো, দুতার্তে এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা সন্দেহভাজন মাদক ব্যবহারকারী ও কারবারিদের হত্যার প্রচার ও উৎসাহ দিয়েছিল। সেইসাথে এটি দাবি করেছে, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীরা ফিলিপাইনে হাজার হাজার বেআইনী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।

২০২১ সালের প্রথমার্ধে আইসিসির আনুষ্ঠানিক তদন্তের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। প্রতিবেদনে এই বিলম্বের জন্য করোনাভাইরাস মহামারিকে দায়ী করা হয়েছে।

২০১৬ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করা দুতার্তে মাদকের বিরুদ্ধে নিরলস যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিষয়টি তিনি একই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও প্রচার করেছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ২০১৭ সালে পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘মাদক থেকে মুক্তি পেতে হলে আমি আরো হত্যা করব’ বলে মাদক সন্দেহভাজনদের দেখা মাত্রই ‘গুলি ও হত্যা’ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আইসিসির এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা তাদের মাদকবিরোধী ক্র্যাকডাউন চলাকালে ৫ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করেছে।

আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা সরাসরি না করলেও এই হত্যাকাণ্ডগুলো ‘পরিকল্পিত, পরিচালিত বা সমন্বিত’ বলে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন বলছে, অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীদের দ্বারা আরো হাজার হাজার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

আইসিসি থেকে পদত্যাগ
ফিলিপাইন পুলিশের মতে, ৩০ জুন, ২০১৬ দুতার্তের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার দিন থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুলিশী অভিযানে কমপক্ষে ৫ হাজার ৫৫২ জন মানুষ নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে প্রকাশিত পূর্বের একটি প্রতিবেদনে অবশ্য মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০০ দেখানো হয়েছিল। সংখ্যাটি কেন সংশোধন করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা পুলিশ দেয়নি।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ‘অজ্ঞাত বন্দুকধারী’ এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, যাদের অনেকে পরে পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে এক ডজনের বেশি ছিলেন শহরের মেয়র এবং আইনজীবী ও জজসহ স্থানীয় কর্মকর্তা।

বেশ কয়েকজন অপ্রাপ্তবয়স্ককেও হত্যা করা হয়েছিল, যারা কোনোভাবেই মাদক কারবারের সাথে জড়িত ছিল না। তবে তাদের নিহত হওয়াকে সরকার ‘সমান্তরাল ক্ষয়ক্ষতি’ বলে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে।

ফিলিপাইনে মাদকের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধের বিষয়ে আইসিসির প্রাথমিক তদন্ত দুতার্তেকে ক্ষুব্ধ করেছিল, যার ফলস্বরূপ ম্যনিলা আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি থেকে সরে আসে।

আইসিসির সাথে মতবিরোধের জেরে ফিলিপাইনে তদন্তের জন্য গেলে বেনসোদাকে গ্রেফতারের হুমকিও দিয়েছেন দুতার্তে।
তিনি বেনসোদাকে ‘সেই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ফিলিপাইনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের সাবেক বিশেষ দূত আগনেস কালামার্ডকে ‘চর্মসার’ এবং ‘অপুষ্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। তার এই দুই বক্তৃতা ‘বর্ণবাদী এবং যৌনতাবাদী’ হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল।

আইসিসি থেকে ফিলিপাইনের পদত্যাগ সত্ত্বেও বেনসোদার কার্যালয় উল্লেখ করেছে, ২০১১ সালে ফিলিপাইন রোম আইনে স্বাক্ষর করার সময় থেকে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চে এটি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রটির দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহের অভিযোগ তদন্ত করার এখতিয়ার এখনো আইসিসির রয়েছে। এটি আরো বলেছে, ‘আদালতের এখতিয়ারের অনুশীলন কোনো সময়সীমা সাপেক্ষে নয়’।

রোম আইন একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যা আইসিসি প্রতিষ্ঠা করে। এটি গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনমূলক অপরাধের বিচার করে থাকে। এটি ২০০২ সালে কার্যকর হয়েছিল।

মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুতার্তের মুখপাত্র হ্যারি রোক অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, এখন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আইসিসির আর এখতিয়ার নেই।

‘আমরা আইসিসির এখতিয়ারকে স্বীকৃতি দিই না, তাই আমরা চিন্তিত নই,’ তিনি বলেছিলেন।

যদিও আইসিসির আনুষ্ঠানিক তদন্তের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, তবে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমালোচক ফিলিপাইনভিত্তিক ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিপলস লায়ার্স (এনইউপিএল) সর্বশেষ আইসিসির প্রতিবেদনটিকে ‘অত্যন্ত বিবেচ্য অগ্রগতি, যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া রয়েছে’ বলে অভিহিত করেছে।

এনইউপিএলের সভাপতি এড্রা ওয়ালিয়া এক বিবৃতিতে আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘আমাদের সরকার ও আইন প্রয়োগকারীদের অবশ্যই এটিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং বার্তাটি উচ্চস্বরে ও স্পষ্টভাবে পেতে হবে’।

‘যদিও আমরা এখনো সঙ্কটমুক্ত নই, তবুও অবশেষে দায়মুক্তির ঘোর কালো মেঘের আড়ালে আশার রশ্মি উঁকি দিয়েছে।’

মানবাধিকার গোষ্ঠী কারাপতন আইসিসির এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, ‘দুতার্তের সন্ত্রাসবাদের রাজত্বের ক্ষণগণনার দিন নিকটবর্তী হচ্ছে।’

আইসিসি থেকে সরে আসার পর থেকে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে।
কোভিড-১৯ এর কারণে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এবং জাতীয় লকডাউনেও দুতার্তের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বন্ধ হয়নি, বরং অজ্ঞাত হামলাকারীদের দ্বারা প্রচুর মানুষ নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, ডিসেম্বর ২০১৯ এর সর্বশেষ পুলিশ প্রতিবেদনের পর থেকে ৩১ আগস্ট, ২০২০ পর্যন্ত পুলিশের অভযানে ৩০০ জনেরও বেশি সন্দেহবাজন মাদক কারবারি নিহত হয়েছে।

পুলিশের মতে, সন্দেহবাজনরা গ্রেফতার প্রতিহত করার চেষ্টাকালে নিহত হয়।

আইসিসি কৌঁসুলি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করলেও ফিলিপাইন সরকার এখন পর্যন্ত ‘সীমিত সংখ্যক তদন্ত ও মামলা-মোকদ্দমা’ পরিচালনা করেছে।

সূত্র : আলজাজিরা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com