করোনার মধ্যেই ডেঙ্গু আতঙ্ক: রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ১১ রোগী
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমানতালে চোখ রাঙাচ্ছে মশকবাহিত রোগ ডেঙ্গু। চলতি বছর রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে নতুন মেয়রদ্বয় দায়িত্ব নেওয়ার পরে সাঁড়াশি অভিযানে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে মশার উপদ্রব। শূন্যের কোঠায় নেমেছিল আক্রান্তের সংখ্যাও। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মশকবিরোধী অভিযানে ভাটা পড়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও মশককর্মীদের গা-ছাড়া মনোভাবে রাজধানীজুড়েই বাড়ছে মশার উপদ্রব। গতকাল একদিনেই ১১ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৬।
করোনাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ডেঙ্গু। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ছিল এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪৮ জন। যদিও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশর বেশি মানুষের এ রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত রোগী কখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সে সময় ৫ হাজার ৫১১ রোগী ভর্তি হয়েছিল, আর মারা যায় ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়।
এর পর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও এতে মৃত্যু কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বছরে আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে থাকে, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ালেও পরের বছর আবার কমে যায়। এর পর আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ২০১৮ সালে, ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে ২৬ জন মারা যায়। আর গত বছরে প্রাদুর্ভাব বেড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়।
২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে সরকারের খাতায়। সেখানে গত বছরের আগস্টেই আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।
ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগের আঙুল উঠেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দিকে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। রাজধানী দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। এমনকি ডেঙ্গুর এমন সময়ে বেফাঁস মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েন দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে মেয়র পদ থেকেই ছিটকে পড়েন।
ওই সময় হাইকোর্টও বলেছিল, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণেই সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও মানসিকতার অভাবেই পরিস্থিতি এমন হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পরই মশক নিধন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজান। এর অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টাব্যাপী প্রতি ওয়ার্ডে নির্ধারিত আটজন মশককর্মী বিভিন্ন স্থানে লার্ভিসাইডিং চালু করেন। অন্যদিকে দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিং করা হয়।
তবে সরেজমিন বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় এক মাস ধরে মশক নিধন অভিযানে গাফিলতি এসেছে। শুরুর দিকে মশককর্মীরা নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও বর্তমানে সেভাবে ওষুধ ছিটানো হয় না। ফলে মশার উপদ্রব আবার বেড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, মশক নিধনে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। পাশাপাশি যেসব ওয়ার্ড থেকে মশার উপদ্রবের অভিযোগ পাচ্ছি, সেসব ওয়ার্ডে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ সিটিজুড়ে মশক নিধন অভিযানে তদারকিও বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম জরুরি সভা করেন গত বৃহস্পতিবার। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আগামীকাল থেকে ডিএনসিসি এলাকায় ১০ দিনব্যাপী বিশেষ মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম (চিরুনি অভিযান) শুরু করা হবে। অভিযানের পাশাপাশি মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হবে। গতকাল সন্ধ্যায়ও উত্তর সিটির সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের নিয়ে মশক নিধন কার্যক্রমের বিষয়ে অনলাইনে মিটিং করেন আতিকুল।
এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, যে কোনো মূল্যে নগরবাসীকে মশা এবং মশাবাহিত রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এ জন্য আমরা চতুর্থ প্রজন্মের কীটনাশক আমদানি করেছি। ইতোমধ্যে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে এবং আরও আনা হচ্ছে।