আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভের কারণ
চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভের কারণ আল্লামা শফিপূত্র আনাস মাদানীর ‘স্বেচ্ছাচারিতা’। মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক পদে আসীন হয়ে একের পর এক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে।
এরমধ্যে হেফাজতের ফান্ডের টাকা তছনছ, সিনিয়র নেতৃবৃন্দের অবমূল্যায়ন, হেফাজতের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা, নিয়মনীতি না মেনে মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত করা, কওমি মাদ্রাসার সনদ স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে হেফাজত নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ না করে একচ্ছত্রভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্তই এই ক্ষোভের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, আল্লামা শফী হুজুর বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। একাধিকবার তাকে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। মাদরাসার প্রশাসনিক তদারকিতে তিনি অক্ষম হয়ে পড়েছেন। নিজের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আল্লামা শফী দাপ্তরিক কাজে মাওলানা আনাস মাদানীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
এ সুযোগে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আল্লামা শফীর প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদকে বিনা নোটিশে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
একইভাবে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কমপক্ষে ১১ জন শিক্ষক-কর্মকর্তাকে বিনা কারণে মৌখিক নির্দেশে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এছাড়া হাটহাজারী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি মাদরাসা বোর্ডের (বেফাক) ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন আনাস মাদানী। কওমি সনদ স্বীকৃতি নিয়ে হেফাজতে ইসলামের মধ্যে সংকট তৈরি করেন তিনি। যার কারণে হেফাজত ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনিয়র ধর্মীয় নেতা মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এই সময় বাবুনগরীর পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মুফতি ইজহারুলসহ প্রায় ৫০০ আলেম।
মুফতি ইজহারুল ইসলাম ওই সময় হেফাজতে ইসলামে সৃষ্ট সংকটের কারণ, সংকট থেকে উত্তরণের উপায়, শাপলা চত্বরে ঘোষিত কর্মসূচিতে দলীয় সমন্বয়হীনতাসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, যখন কোনো কিছুর মাত্রাতিরিক্ত হয় তখনই তা নিয়ে বিভিন্ন জনের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি। কোনো কিছু পেলে শুকরিয়া আদায় করতে হয়। কিন্তু সেই শুকরিয়া যদি কখনো অতি শুকরিয়ার পরিণত হয় তখই বিপত্তি দেখা দেয়।
তিনি বলেন, কওমি সনদ স্বীকৃতির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন মাওলানা আনাস মাদানী। এ ঘটনায় মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবু নগরীর মতো একজন সিনিয়র আলেমেদ্বীন হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করলো। এটা কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান মেনে নিতে পারেননি।
তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি এটা আমাদের অধিকার। অধিকার আদায় করার মানে এই নয় যে, আমরা কারো কাছে বিক্রি হয়ে গেলাম। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়টি চারদলীয় জোট আমলেই চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু তখন সময় না পাওয়ায় ঘোষণা দিতে পারেনি তৎকালীন বিএনপি সরকার। এই স্বীকৃতির জন্য কাজ করেছি আমি ও মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
তিনি বলেন, ৫ মে শাপলা চত্বরে ট্রাজেডিতে হেফাজত আমীর আল্লামা শফির সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই হেফাজতের আন্দোলনে ছিল। ব্লগাররা যখন আমাদের প্রিয় নবী ও তার স্ত্রীদের নিয়ে কটুক্তি করেছিল। রাসূলের শানে বেয়াদবি করেছিল তখই এর প্রতিবাদ জানাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। আল্লামা শফি সাহেব আমাদের মুরুব্বী হওয়াতে আমরা তাকে সামনে রেখেছি।
কিন্তু সেই দিন শফি সাহেব জাতিকে এক বিশাল সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। তার মাদ্রাসার শিক্ষক ও হেফাজত নেতা জুনাইদ বাবুনগরীকে রেখে চলে আসেন তিনি। পুলিশের যতই ক্ষমতা থাকুক সেই দিন শফি সাহেব যদি বলতেন আমি আমার শিক্ষক ও ছাত্রদের না নিয়ে যাব না তাহলে পুলিশ আমাদের দাবি মানতে বাধ্য হতো।
আর এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এরই পেক্ষিতে বুধবার জোহরের নামাজের পর থেকে শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রদের দাবি ছিলো, মাদ্রাসা থেকে মাওলানা আনাস মাদানীর অপসারণ, আল্লামা শাহ আহমদ শফির অবসর, চাকুরিচ্যুত শিক্ষক-কর্মচারীদের বহাল, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা।
তবে আশার বিষয় হচ্ছে, ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে বুধবার রাতে মাদ্রাসার শুরা মজলিসের তিন সদস্যের বৈঠকে মাওলানা আনাস মাদানীকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর বাকী সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে শনিবার বৈঠকে বসার কথা জানানো হয়। ফলে রাত ১১টার পর বিক্ষোভ থামায় ছাত্ররা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা সদস্য ও মেখল মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা নোমান ফয়জী।
এ বিষয়ে কথা বলতে মাওলানা আনাস মাদানীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করনেনি তিনি। এমনকি বিষয়বস্তু জানিয়ে মেসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার রাশেদুল হক বলেন, বুধবার দুপুর থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা মাদ্রাসা অবরুদ্ধ করে রাখার খবর পাওয়ার পর আমরা সতর্ক অবস্থানে থাকি। যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশ র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে।