ইউএনও হত্যাচেষ্টা: ফেঁসে যাচ্ছেন একজন শীর্ষস্থানীয় আ.লীগ নেতা!
পুলিশের হাতে আটকের পর ছেড়ে দেয়া ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগ আহ্বায়ক (সদ্য বহিষ্কৃৃত) জাহাঙ্গীর আলমকে খুঁজছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। গ্রেফতারকৃত ৩ আসামিকে রিমান্ডে নেয়া ও গত সোমবার ২ সরকারি কর্মচারীর আটকের পর হত্যা চেষ্টার ঘটনা এখন অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। চুরির ঘটনায় নয়, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন একজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্যই এমন সন্ত্রাসী পথ বেছে নিয়েছিলেন ওই নেতা। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সবুজ সঙ্কেত পেলেই ওই নেতা আটক হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ইমাম আবু জাফরের নেতৃত্বে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রধান আসামি আসাদুল হক, পরিকল্পনাকারী নবীরুল এবং সান্তু চন্দ্র রায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ৩ জনের কাছে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে ঘটনার নেপথ্যসহ সব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র বের করার চেষ্টা করছেন, তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ইমাম আবু জাফর। ঘটনাটি চুরির বলে দাবি করা হলেও ইমাম জাফর বলেছেন, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়েও দিয়েছে। সদ্য বহিষ্কৃত এক যুবলীগ নেতাসহ ইউএনও ওয়াহিদা হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেফতার ওই ৩ আসামি ‘চুরির উদ্দেশ্যে’ ইউএনওর সরকারি বাসভবনে গিয়েছিল বলে র্যাবকে জানিয়েছে। কিন্তু ঘোড়াঘাটের অধিকাংশ মানুষ র্যাবের কাছে আসামিদের দেয়া ওই জবানবন্দী বিশ্বাস করতে পারছেন না। এলাকাবাসীর অনেকেরই অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রাফে খোন্দকার সাহানশাহর মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছেন ইউএনও ওয়াহিদা। নিছক চুরির উদ্দেশে ওই হামলা করা হয়নি। বরং কোনো এক পক্ষের সাথে ইউএনও ওয়াহিদার বনিবনা না হওয়ার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
এলাকাবাসীর মতে- বালুমহাল, খাসজমি দখল, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজিতে নানা সময়ে বাধা ও মতের অমিল ঘটায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে হত্যার উদ্দেশ্যে, না শুধু ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন। গত বুধবার গভীর রাতে ইউএনওর বাসভবনে হামলার ঘটনাটি যে পরিকল্পিত ছিল সে বিষয়ে তারা অনেকটা নিশ্চিত। আর এসবের মূল মদদদাতা হিসেবে নাম উঠে আসে ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাহানশাহর। গত উপজেলা নির্বাচনে সাহানশাহর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
কিন্তু এই নির্বাচন নিয়েও অভিযোগ আছে বিস্তর। নির্বাচনে বিএনপি থেকে কোনো প্রার্থী না থাকায় ঘোড়াঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শুভ রহমান চৌধুরী প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের কাগজপত্র জমা দিতে গেলে রাস্তায় তার কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা! পরে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হন সাহানশাহ। কাগজপত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওই সময় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শুভ রহমান চৌধুরী দিনাজপুর জজকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। যেখানে আসামি করা হয় বদরুল ও সুজনসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো কয়েকজনকে। তার মধ্যে বদরুল ছিলেন ঘোড়াঘাট উপজেলার ১ নম্বর বুলাকীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এ ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন সদ্য বহিষ্কৃত যুব লীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম ও বর্তমান ঘোড়াঘাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউনুস মণ্ডল! বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মাদক, চাঁদাবাজি, হামলা ও জমি দখলসহ আছে নানা ধরনের অভিযোগ।
অন্য দিকে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন-পালন করার কারণে উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের। এর আগে ২ নম্বর পালসা ইউনিয়নের সাবেক যুবলীগ সভাপতি মিনহাজুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে ময়নুল ও ফয়সাল প্রধানদের আক্রমণের শিকার হন ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান কবিরুল ইসলাম। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের। মূলত স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, উপজেলা চেয়ারম্যান সাহানশাহ, পৌর মেয়র আব্দুস সাত্তার মিলন ও আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস মণ্ডলের চতুর্মুখী চাপে পড়েন ইউএনও ওয়াহিদা খানম।
স্থানীয়দের ধারণা, এই চতুর্মুখী চাপেই কোনো একপক্ষ ইউএনওকে শায়েস্তা করার জন্য নতুবা হত্যা করার উদ্দেশ্যে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব বিষয় তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি জানান স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাত ৩টার দিকে ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা। হত্যার উদ্দেশ্যে তারা ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। আহত বাবা-মেয়েকে প্রথমে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় পরে ইউএনও ওয়াহিদাকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। বর্তমানে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ইউএনও ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।