আশুরায় বিশ্বনবির আমল
হিজরি বা আরবি বছরের প্রথম মাস মহররম। কারবালার ঘটনার বহুকাল আগে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে। মহররম মাসের সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা থাকায় এই মাসে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুটা পরিবর্তন আনতেন। তিনি নফল রোজা রাখতেন। বিশেষ দোয়া করতেন এবং তাঁর উম্মতকে আশুরায় রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া এ মাসের আশুরার দিনটি মুসলিম বিশ্বের কাছে গভীর শোক ও বেদনার দিন। কেননা এ দিনে বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অন্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে তিনি চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। তাইতো ঐতিহাসিকভাবেই এ দিনটি অনেক গুরুত্ববহ।
তবে এ ঘটনার আগে থেকেই আশুরায় রোজা রাখার ব্যাপারে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ থেকে নির্দেশ পেয়ে থাকি। এ দিনে রোজা রাখার গুরুত্ব হাদিসে বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বাধিক উত্তম রোজা হলো মহররম মাসের রোজা। আর ফরজের পরে সর্বাধিক উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (মুসলিম)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে ইয়াহুদিদের আশুরার রোজা রাখতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন-
তোমরা এটা কিসের রোজা রাখ?
তারা উত্তরে বলল- আশুরা একটি বড় দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তিদান করে ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিল।
ফলে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ওই দিন রোজা রেখেছিলেন। আর আমরা তার অনুকরণেই এ রোজা রাখি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বললেন- তোমাদের তুলনায় মুসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে আমাদের হক বেশি। অতএব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (মিশকাত)
হজরত আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই রোজা বিগত বছরের গোনাহ মুছে দেয়।’ (মুসলিম)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার দিনে রোজা পালন করতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও সে সময়রোজা পালন করতেন। মদিনায় এসেও তিনি রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও নির্দেশ দিলেন। রমজানের রোজার আদেশ নাজিল হলে আশুরা দিবস বর্জন করা হয়। এখন কেউ চাইলে তা পালন করুক, আর চাইলে তা বর্জন করুক।’ (বুখারি)
পবিত্র এ মহররম মাসে আশুরা উপলক্ষ্যে দুদিন অর্থাৎ ৯ এবং ১০ মহররম রোজা রাখার ব্যাপারেও হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজা রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে রোজা রাখতে বলেন। তখন তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বলল-হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এ দিনটিতে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরাও রোজা পালন করে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ চাইলে আমরা পরের বছর নবমীর দিন (মহররমের ৯ তারিখও) রোজা পালন করব। কিন্তু পরের বছর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইনতেকাল করেন।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিই মাসেই কম বেশি নফল রোজা রাখতেন কিন্তু রমজানের রোজার পর মহররম মাসের রোজাকে তিনি অনেক গুরুত্ব দিতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (মুসলিম, তিরমিজি)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারি)
সুতরাং আবেগ-তাড়িত হয়ে আমরা যেন এমন কোনো কাজ না করি, যা ইসলামে বেদাআত বা নতুন সৃষ্টি। বরং তা যেন জাতীয় কবির মোহররম কবিতার সুরের সঙ্গে মিলে যায়-
‘কত মোহররম এল গেল চলে বহু কাল–
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুসলিম! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্রম মাহিনা,–
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!’
তাই আশুরা এলেই এ উপলক্ষ্যে অনৈসলামিক কোনো কার্যক্রম না করে বরং হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর ত্যাগের কথা চিন্তা করে এবং মহররম মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদেরকে রোজা, নফল ইবাদত, দোয়া, ইসতেগফারে নিয়োজিত থাকা উচিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের আদেশ-নিষেধ এবং মহররমের শিক্ষার উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।