সদরঘাটে লঞ্চডুবি: জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন আসামিরা
ঢাকা সদরঘাটে নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল দেশকে। সেই ঘটনার পর প্রায় দুই মাস হতে চলেছে।
এজাহারভুক্ত সব আসামি গ্রেফতার হলেও অভিযোগপত্র দাখিলের কোনো খোঁজ নেই। তবে এরই মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছেন।
গত ২৯ জুন সকালে দুর্ঘটনা কবলিত এমএল মর্নিং বার্ড নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়।
এ ঘটনার পর সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে দেখা যায় পেছনে চলতে থাকা ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ছোট আকারের মর্নিং বার্ড লঞ্চটি মুহূর্তের মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায়।
দুর্ঘটনার পর গত ৩০ জুন সদরঘাট নৌ-পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামসুল আলম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছেন সদরঘাট নৌ-থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল আলম।
মামলায় দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটিকে ধাক্কা দেওয়া ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ, মাস্টার আবুল বাশার, মাস্টার জাকির হোসেন, স্টাফ শিপন হাওলাদার, শাকিল হোসেন, হৃদয় ও সুকানি নাসির মৃধার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে ময়ূর-২ লঞ্চের সুপারভাইজার আব্দুস সালামকে ৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয়। এরপর ৮ জুলাই ওই লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ, ১২ জুলাই মাস্টার আবুল বাশার, ১৪ জুলাই দুই ইঞ্জিন চালক শিপন হাওলাদার ও শাকিল হোসেন, ১৫ জুলাই সুকানি নাসিরুদ্দিন মৃধা, ২৩ জুলাই সহকারী মাস্টার জাকির হোসেন এবং ২৬ জুলাই এই মামলার এজাহারভুক্ত সবশেষ আসামি হৃদয় গ্রেফতার হন।
গ্রেফতারের পর আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মাস্টার আবুল বাশার ও সুকানি নাসির। জবানবন্দিতে বাশার ও নাসির একে অপরের উপর দায় চাপান। এছাড়া নাসিরের জবানবন্দিতে ময়ূর ২ এর মালিকের দায়ও ওঠে আসে।
এজাহারভুক্ত সব আসামি গ্রেফতারের পরও পেরিয়ে গেছে প্রায় এক মাস। তবে এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কোনো খবর নেই।
ইতোমধ্যে মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন্নাহারের প্রথম দফায় বেধে দেওয়া ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় পেরিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদরঘাট নৌ-থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোর্শেদ তালুকদার বলেন, এ মামলার প্রতিবেদন দাখিলের ব্যাপারে এখনই কোনো সময়সীমা বলতে পারছি না। এটি গুরুতর একটি ঘটনা। দুর্ঘটনায় ৩৪ জন মানুষ মারা গেছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ও একটি তদন্ত কমিটি করেছে। তাদের দুর্ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। সেটাও দাখিল হয়নি। সেই প্রতিবেদনের বিষয়গুলোও দেখার আছে। তাই এই মামলার আসামিরা গ্রেফতার হলেও সবদিক যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগছে। সব মিলিয়ে অভিযোগপত্র দাখিলে আরও সময় লাগবে।
তবে অভিযোগপত্র দাখিলে এই দেরির কারণই আসামিদের জামিনে বেরিয়ে যেতে সহায়ক হচ্ছে। কারণ এ মামলার এজাহারে দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়াভাবে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণহানির জন্য ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার প্রত্যেকটি ধারা জামিনযোগ্য। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ৩০৪ (ক) ধারায় আনা হয়েছে। এই ধারায় অবহেলায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর কারাদণ্ড।
এরই মধ্যে মামলার প্রধান আসামি ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদ গত ২৯ জুলাই ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরী আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। মামলার অন্য আসামিরাও একই আদালতে জামিনের আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। দ্রুতই সেসব আবেদনের ওপর শুনানি হবে। তাই দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া না হলে বিচার শুরুর আগেই অন্য আসামিদেরও জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন অভিযোগপত্রে গুরুতর জামিন অযোগ্য কোনো অভিযোগ এলে তখন হয়তো আসামিদের জামিন ঠেকানো সম্ভব ছিল।
ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল বলেন, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছে। এরপরও তদন্তে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি হত্যা মামলায়ও রূপান্তর হওয়া সম্ভব। তেমনটি হলে আসামিদের জামিনে বেরিয়ে যাওয়া কঠিন হতো। এজন্য মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল হওয়া দরকার।