‘হার্ড ইম্যুনিটি’ই করোনা মোকাবেলার সহজ উপায়!

লকডাউনের বাধা পেরিয়েও করোনা সংক্রমণের গ্রাফ বর্তমানে রয়েছে উর্ধ্বমুখী। উত্তরণের উপায় কি তবে দীর্ঘস্থায়ী এই লকডাউন নাকি আছে অন্য কোনো উপায়?

উত্তরটি হতে পারে হার্ড ইম্যুনিটি।

হার্ড ইম্যুনিটি সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানা দরকার ইম্যুনিটি কী। আপাতদৃষ্টিতে ‘ইম্যুনিটি’ অর্থ ‘রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা’।

ফার্মেসির ভাষায় আমাদের শরীরে প্রাপ্ত ইম্যুনিটি মূলত ২ প্রকার।

1.Innate Immunity (প্রাকৃতিক বা জন্মগত রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা)
2. Acquired Immunity (অর্জিত রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা)

অর্জিত রোগ প্রতিরোধক এই ক্ষমতা ব্যাক্তিবিশেষে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের জনসমষ্টির তুলনায় আফ্রিকা বা এশিয়া মহাদেশের জনসমষ্টির তাপ সহনশীলতা অনেক বেশি। এটা তাদের অর্জিত ইম্যুনিটি বলা যায়। অর্জিত ইম্যুনিটিকে ভাঙলে দুটি অংশ পাওয়া যায়।

i. Active Immunity (সক্রিয় রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা) : সাধারণত হার্ড ইম্যুনিটি বলতে অনেকটা এই ধরনের ইম্যুনিটিকেই বোঝানো হচ্ছে। অ্যাক্টিভ ইম্যুনিটির ক্ষেত্রে শরীরে নিষ্ক্রিয় বা মৃত ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। এরপরে আমাদের শরীরে ভাইরাসের গঠন ও ইত্যাদি তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিরোধী অ্যান্টিবডিস তৈরী করে। পরে যখন আবার ওই একই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, এই এন্টিবডিগুলো সক্রিয় থাকে বলে আক্রমণের আগেই ভাইরাস পরাজিত হয়। টিটি, ডিপিটি প্রতিষেধকগুলো এই শ্রেণির।

ii. Passive Immunity (নিষ্ক্রিয় রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা) : এক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা এন্টিবডি শরীরে প্রবেশ করানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধনুষ্টংকার প্রতিরোধে ব্যাবহৃত এন্টি-টিটেনাস সিরাম।

করোনাভাইরাস চিকিৎসায় বর্তমানে গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে প্লাজমা বা সিরাম থেরাপি। এই পদ্ধতিতে প্রথমে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হওয়া ব্যাক্তির শরীর হতে রক্ত নিয়ে করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে রক্তকণিকা ও প্লাজমা আলাদা করে এন্টিবডিস সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতি ব্যাবহারে অনেকেই সেরে উঠলেও এখন পর্যন্ত প্লাজমা থেরাপি রয়েছে গবেষণার পর্যায়েই। সুতরাং গবেষণা ছাড়া এই পদ্ধতি ব্যবহার অবৈধ।

যেহেতু প্লাজমা অবৈধ,অতএব হার্ড ইম্যুনিটির দিকেই দৃষ্টিপাত করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলছে লকডাউন কিন্তু এই মুহূর্তে নিউইয়োর্ক সিটির রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব পরিসংখ্যান, মহামারিতত্ত্ব ও গবেষণা ডিজাইন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নট উইটকোভস্কির দাবি মহামারীকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে এই লকডাউনের মাধ্যমে। প্রেস অ্যান্ড প্রজেক্টের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে মার্কিন এই বিশেষজ্ঞ বলেন,মহামারীর বক্ররেখাকে সমতল করার প্রচেষ্টায় সকলে ভুলে যাচ্ছে রেখাটি টেনে আরো বেশি প্রশস্ত করা হচ্ছে। তার মতে,শ্বাসযন্ত্রজনিত সকল রোগ থামানোর একমাত্র উপায় হলো গণ-রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। জনসাধারণের ৮০ ভাগ মানুষকে এই রোগের সংস্পর্শে আসতে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। নট উইটকোভস্কির সূত্র অনুসারে, হার্ড ইম্যুনিটিই হতে পারে বিশ্বব্যাপী এই করোনা মহামারী প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র।

সক্রিয় ইম্যুনিটির সাথে সাদৃশ্য থাকলেও করোনা প্রতিরোধে হার্ড ইম্যুনিটি ধারণ করতে পারে মারাত্মক আকার।“হার্ড ইম্যুনিটি’ শব্দটিকে তুলনা করা যায় বন্য পশুর পালের সাথে। বন্য পশুদের মধ্যে সংক্রামক রোগ ছড়ালে তাদের বেঁচে থাকা হয় অনেকটা প্রাকৃতিক উপায়েই। একটি পশুর পাল সংক্রমক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, দুর্বল বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম,পালের সেই পশুগুলো মৃত্যুবরণ করে এবং কিছু পশু প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে অর্জন করে হার্ড ইম্যুনিটি। অর্জিত এই ইম্যুনিটি পরে একই ভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচায় সুস্থ পশুদেরকে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন নলেজ প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে,যখন কোনো এলাকার বেশির ভাগ মানুষকে একটি সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন দেয়া থাকে, তখন সেখানে সংক্রমণের আশঙ্কা আর থাকে না। কমিউনিটিজুড়ে একটি সুরক্ষা বলয় কাজ করে। মূলত এটিই ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ বা ‘কমিউনিটি ইম্যুনিটি’।

যেহেতু করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, সুতরং এক্ষেত্রে হার্ড ইম্যুনিটি সৃষ্টি হবে তখনই যখন কোনো দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে এবং কিছু মানুষ করোনাকে পরাজিত করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। সুস্থ ব্যক্তিদের শরীরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধক ক্ষমতা থাকবে এবং এভাবেই গড়ে উঠবে হার্ড ইম্যুনিটি।

করোনা প্রতিরোধে স্বীকৃত কোনো উপায় নয় হার্ড ইম্যুনিটি। এ উপায়ে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে শতভাগ মানুষেরই। এমনকি ভাইরাসটি যদি আবার মিউটেডেড বা জিনগত বৈশিষ্টে পরিবর্তন আনে, তবে মৃতের মিছিলে শামিল হতে পারে শতভাগ লোকই।

শুরু থেকেই করোনা প্রতিরোধক কোনো লকডাউন মানেনি সুইডিশ জাতি। তাদের দেশে বর্তমানে সংক্রমিতের সংখ্যা ২৪ হাজার ৬২৩ জন এবং মৃত ৩,০৪০ জন। হয়তোবা,হার্ড ইম্যুনিটির পথেই হাঁটছিলেন তারাও।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের ক্ষেত্রে হার্ড ইম্যুনিটির প্রথম ধাপে সংক্রমণ খুব দ্রুত হবে কিন্তু দেশের ৮০ শতাংশ বা প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে একসাথে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা মোটেও সহজ হবে না। এক্ষেত্রে ভেঙে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি, স্থবির হয়ে যেতে পারে পুরো দেশ। ধ্বংসযজ্ঞ শেষে,মৃত্যুঞ্জয়ী সোনার হরিণ ইম্যুনিটি অর্জনকারী সৈনিকের সংখ্যা কত হতে পারে, সেটিও একটি ধোঁয়াশা।

লেখক
এম. এস. ইন ফার্মাকোলজি (শিক্ষার্থী)
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

Comments (০)
Add Comment