‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি’
সংক্রামক রোগ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, ফাংগাস ও ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে এইসব জীবাণু শনাক্ত করা যায় এবং তা সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করলে একই রোগ হয়। নতুন রোগীর দেহ থেকে একই জীবাণু আবার শনাক্ত করা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান কোনো স্বপ্নে পাওয়া চিকিৎসা নয়। এটা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। যেমন করোনাভাইরাসের জীবাণু রোগীর শরীর থেকে শনাক্ত করা যায়। এটি দেখতে মুকুটের মতো। এমনকি রোগী হাঁচি বা কাশি দিলে ভাইরাস বহনকারী জলীয় কণাগুলো কিভাবে বাতাসে ছড়ায় তাও লেজার বিম দিয়ে দেখা যায়।
প্রথম তিন প্রকারের সংক্রামক রোগ অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি।
তবে রাসূল সা: আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি’ (বুখারি, কিতাবুত তিব্ব)।
কাজেই এ রোগেরও ওষুধ অদূরভবিষ্যতে আবিষ্কার হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্স্থু, মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে হবে কিছু সময়ের জন্য আর অসুস্থ রোগীকে দ্রæত শনাক্তকরণ এবং আইসোলেশন করতে হবে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান, জাপান প্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ মহামারীর শুরুতে গুরুত্ব না দেয়ায় রোগের পরিসংখ্যান দেখুন : ১ জানুয়ারি একজন, ১ ফেব্রæয়ারি সাতজন, ১ মার্চ ৭৪ জন, ১ এপ্রিল এক লাখ ৯০ হাজার। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে দুই মাসের মধ্যেই এটি মহামারী ধারণ করবে আমাদের দেশেও।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি চিকিৎসা সম্পর্কে না জেনে চিকিৎসা করে, তবে সে দায়ী হবে (ভুল চিকিৎসার জন্য)’ (আবু দাউদ-দিয়াত অধ্যায়)। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ চিকিৎসাবিজ্ঞান না জেনেই করোনার ব্যাপারে চিকিৎসকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ কেউ রাসূল সা:-এর হাদিসের অপব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি বলতে কিছু নেই। কেউ কেউ বলছেন, বেশি বেশি মসজিদে জমায়েত হয়ে আল্লাহর দরবারে রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতে; তাতেই আশা করা যায় এই মহামারী থেকে আমরা মাফ পেয়ে যাবো।’ এ ব্যাপারে দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি : ১. সপ্তম বা অষ্টম হিজরিতে দামেস্কের বড় বড় মুহাক্কিক আলেমদের কথা উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ গণজমায়েত করেছিল। ঘণ্টাখানেক ধরে তারা প্লেগ মহামারী থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে অনেক কান্নাকাটি করে। এ সমাবেশের পর মহামারীতে মৃত্যুর হার কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ২. হিজরি ৮৩৩ সনে মিসরে প্লেগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। সাধারণ মানুষ আবার গণজমায়েত করে এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে অনেক কান্নাকাটি করেছে। এ সমাবেশের আগে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন করে মারা যেত। আর এ সমাবেশ থেকে রোগটি এত দ্রæত ছড়িয়ে পড়ল যে, প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষ মারা যেতে লাগল।
সম্প্রতি নয়াদিল্লির এক মসজিদে জনসমাগমের কারণে বেশ কিছু মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেন এবং অনেকের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
আধুনিক চিকিৎসার সাথে দোয়ার সম্পর্ক কী, এ ব্যাপারে একজন প্রখ্যাত তাফসিরকারক খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন : ‘রাসূল সা: চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহার করতে কখনো নিষেধ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক রোগের ওষুধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তোমরা রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ ব্যবহার করো।’ রাসূল সা: নিজেও লোকদেরকে কোনো কোনো রোগের ওষুধ বলে দিয়েছেন। হাদিস গ্রন্থগুলোয় সঙ্কলিত ‘কিতাবুত তিব্ব’ (চিকিৎসা অধ্যায়) পাঠ করলে এ কথা জানা যেতে পারে। কিন্তু ওষুধ আল্লাহর হুকুম ও অনুমতিক্রমেই উপকারী হতে পারে। নয়তো ওষুধ ও চিকিৎসা যদি সব অবস্থায় উপকারী হতো তাহলে হাসপাতালে একটি রোগীও মারা যেত না। এখন চিকিৎসা ও ওষুধের পাশাপাশি আল্লাহর কালাম ও তার আসমায়ে হুসনা (ভালো ভালো নাম) থেকে যদি ফায়দা হাসিল করা যায়, তা কারো কাছে বিবেকবিরোধী মনে হবে না। তবে যেখানে চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, সেখানে জেনে বুঝেও তা গ্রহণ না করে শুধু দোয়া দরুদের ওপর নির্ভর করা কোনোক্রমেই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে না (তাফহিমুল কুরআন, খণ্ড-১৯ পৃষ্ঠা-২৬৮)’
কেউ কেউ চিকিৎসা বিদ্যা না জেনেও করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দিচ্ছেন। রাসূল সা:-এর কিছু হাদিসের বরাত দিয়ে তারা বলছেন যে, আজওয়া খেজুর বা কালোজিরা খেলে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না। মরহুম ড. ইউসুফ আল কারযাভি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি তার ‘সুন্নাহের সান্নিধ্যে’ বইয়ে লিখেছেন :
সুন্নাহকে বুঝতে সন্দেহ ও ভুলের যেসব কারণ ঘটে তা হচ্ছে এই যে, কিছু লোক স্থায়ী উদ্দেশ্য ও অস্থায়ী উপকরণগুলোকে গুলিয়ে ফেলে। উদাহরণ হচ্ছে, সুন্নাহর কিছু ছাত্রের মধ্যে রাসূল সা:-এর ওষুধ সম্পর্কে উদ্বেগ। যেমন- ‘সর্বোত্তম ওষুধ হিসেবে যা তুমি ব্যবহার করতে পার তা হচ্ছে রক্তমোক্ষণ’ (বুখারি, কিতাবুত তিব্ব) ‘মৃত্যু ছাড়া এমন কোনো রোগ নেই যা কালজিরায় নিরাময় হয় না।’ (ঐ)
আমরা মনে করি, এসব ব্যবস্থাপত্র রাসূল সা: প্রদত্ত ওষুধের মর্ম নয়। বরং এর মর্ম হচ্ছে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পীড়িত হলে চিকিৎসা। এর মর্ম এই যে, চিকিৎসা নেয়া তকদিরে বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়, না আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীলতার বিপরীত। এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা আছে, যা নেয়া সুন্নাত। উপায় ও উপকরণ সময়ে পাল্টায় (যেমন রক্তমোক্ষণ এর স্থান নিয়েছে আধুনিক চিকিৎসা) কিন্তু উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে।
বর্তমানে করোনাভাইরাস চিকিৎসার উপায় ও উপকরণ হচ্ছে, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নীতিমালা, ঘরে অবস্থান, সংক্রমিত রোগীকে চিকিৎসা ও আইসোলেশন। কাজেই এই নীতিমালা না জেনে কেউ যদি মানুষকে আরো সমবেত হতে বলে দোয়ার জন্য, তাহলে এই ভুল চিকিৎসার জন্য তিনি নিজেই দায়ী হবেন, রাসূলের সা: হাদিস অনুযায়ী।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ