হে প্রভু! করোনায় হতাশা নয়, চাই তোমার দয়া
বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলছে। এক দিকে যেমন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে সুস্থ হয়ে কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছে। কেউ আবার মারা যাচ্ছে। তাই বলে হতাশ হয়ে ফরাসি লিগের এক ক্লাবের চিকিৎসকের মতো আত্মহত্যা করা যাবে না।
করোনায় হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দুঃশ্চিন্তায় দিশেহারা হলে চলবে না। অস্থির হয়ে নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে আত্মহত্যাও করা যাবে না। ইসলামে বিশ্বাসী সবার জন্য রয়েছে এতে শিক্ষা ও কল্যাণের হাতছানি।
মুমিন মুসলমানের কাছে দুঃখ এবং সুখের সময় একই রকম। এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, মুমিন কোনো অবস্থাতেই হতাশ হয় না। বিপদ-আপদের এ সব মুহূর্তের বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা তাই প্রমাণ করে। এ আত্মবিশ্বাসের একমাত্র কারণ হলো বান্দার প্রতি আল্লাহর ঘোষণা-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
(হে রাসুল! আপনি) বলে দিন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৫৩)
মহান আল্লাহ তাআলা মানুষের আশা-ভরসার একমাত্র নিরপাদ আশ্রয়স্থল। তিনি সর্বাবস্থায় বান্দার জন্য সহায়। তিনিই বান্দাকে রোগ দিয়েছেন আবার তিনিই রোগ থেকে আরোগ্যদান করবেন। আল্লাহর প্রতি এ বিশ্বাসই মুমিন-মুসলমানকে হাতশ ও দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া থেকে নিরাপদ রাখে।
আল্লাহ তাআলা শুধু রোগ দিয়েই মানুষকে পরীক্ষা করেন না বরং মানুষের মৃত্যু ওফসলের চরম ক্ষতি দিয়েও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। আল্লাহ বলেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। [ সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৭)
মুমিন মুসলমান যদি বিপদ-মুসিবত, রোগ-বালাই, মহামারিসহ যে কোনো কষ্টকর কাজে ধৈর্যধারণ করে তবে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দান করেন আজর বা সাওয়াব। মহামারিতে ধৈর্যধারণ ও তার প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো বান্দা যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান করে। আর নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে সাওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস নিয়ে (ঘরে) অবস্থান করে যে, আল্লাহ তাআলা তাকদিরে যা চূড়ান্ত করে রেখেছেন, তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে একজন শহীদের সমান সাওয়াব।’ (মুসনাদে আহমদ)
আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে এমনি এমনি কোনো মহামারি দেন না। যখন অন্যায়-অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় কিংবা আল্লাহর অবাধ্যতায় মানুষ বেশি লিপ্ত হয়ে যায় তখন তিনি মানুষের মহামারি ও দুর্যোগ চাপিয়ে দেন। আগের যুগে যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে এবং জুলুম অত্যাচারে লিপ্ত হয়েছে তাদের প্রতিও আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব ও দুর্যোগ নেমে এসেছিল। কুরআনের ঘোষণায় এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ
‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পুর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১-৪২)
সুতরাং মহামারি করোনাসহ যে কোনো রোগ-ব্যধি ও কষ্টে হতাশা বা অস্থিরতায় দিন যাপনের কারণ নেই। এ পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ বেচে নেয়াও মারাত্মক অন্যায় ও গোনাহের কাজ।
সব বিপদ-আপদে এ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখা জরুরি যে-
বিপদ-মুসিবত দিয়েছেন আল্লাহ আর তাতে আরোগ্যও দান করবেন তিনি। এতে ধৈর্যধারণে বিনিময় তথা সাওয়াবও দেবেন তিনি। কেননা তিনিই মুমিন বান্দার অভিভাবক।
বান্দা তাকেই রব বা প্রভু বলে স্বীকার করে। তার কাছেই সর্বাবস্থায় সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি সব মানুষকে সুস্থ রেখেছেন আবার যাদেরকে রোগ দিয়েছেন তাদেরও তিনি সুস্থ করেছেন। যাদের ইচ্ছা তিনিই মৃত্যু দিয়েছেন। এ সবই তার একান্ত অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ هَلْ مِن شُرَكَائِكُم مَّن يَفْعَلُ مِن ذَلِكُم مِّن شَيْءٍ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতপর রিজিক দিয়েছেন, এরপর তোমাদের মৃত্যু দেবেন, এরপর তোমাদের জীবিত করবেন। তোমাদের শরিকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে এসব কাজের মধ্যে কোন একটিও করতে পারবে? তারা যাকে শরিক করে, আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মহান।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪০)
সুতরাং যারা দ্বীনের সঠিক বুঝের অভাবে হাতাশার কারণে নিজেদের জীবনকে বিলিন করে দেয়। মুমিন কখনো সেসব হতাশাগ্রস্ত ঈমানহীন মানুষে মতো হতে পারে না।
তাই মুমিন মুসলমানকে বেশি বেশি কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করা জরুরি। ইসলামের আলোকিত জীবনের শিক্ষা নেয়া জরুরি। দ্বীনের সঠিক বিষয়গুলো জেনে নেয়া জরুরি।
যেন কোনোভাবেই কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় গোনাহের কাজে নিজেদের জড়িয়ে না ফেলে। ঈমানের আলো থেকে দূরে সরে না যায়।
রোগ বা মহামারির ভয়ে ভুল পথ অবলম্বন করে আত্মহত্যা কিংবা অন্যায়মূলক কোনো কাজে অংশগ্রহণ না করে সঠিক পথে থাকাই মুমিনের কাজ। মুমিন বান্দার প্রার্থনা হবে এমন- হে প্রভু! মহামারি করোনায় কোনো হতাশা নয়, চাই শুধু তোমার দয়া ও অনুগ্রহ।
মহামারিসহ সব বিপদে আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া লাভে এ দোয়াগুলো পড়া-
– اَللَّهمَّ اِنِّيْ اَسْاَلكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্আলুকাল আ-ফিয়াতা ফিদ-দুন্ইয়া ওয়াল আখিরাহ।’ (তিরমিজি)
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার কাছে দুনিয়া এবং পরকালের সার্বিক নিরাপত্তা ও প্রশান্তি প্রার্থনা করছি।
– رَبِّ أَوْزِعْنِىٓ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِىٓ أَنْعَمْتَ عَلَىَّ وَعَلٰى وٰلِدَىَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صٰلِحًا تَرْضٰىهُ وَأَدْخِلْنِى بِرَحْمَتِكَ فِى عِبَادِكَ الصّٰلِحِينَ
উচ্চারণ : রাব্বি আওঝি’নি আন আশকুরা নি’মাতাকাল্লাতি আনআমতা আলাইয়্যা ওয়া আলা ওয়ালিদাইয়্যা ওয়া আন আ’মালা সালেহাং তারদাহু ওয়া আদখিলনি বিরাহমাতিকা ফি ইবাদিকাস সালিহিন।’ (সুরা নামল : আয়াত ১৯)
অর্থ : হে আমার প্রভু! আপনি আমার প্রতি ও আমার বাবা-মার প্রতি যে (রহমত) অনুগ্রহ দান করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমাকে শক্তি দান করুন আর যেন এমন (নেক আমল) সৎকাজ করতে পারি যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন আর আপনি দয়া করে আমাকে আপনার সৎকর্মশীল (নেক) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন।’
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিন বার বলবে-
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিসসামায়ি, ওয়া হুয়াসসাম উল আলিম।’
সকাল হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এ দোয়া পড়বে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো বিপদ আসবে না।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
অর্থ : ‘আল্লাহর নামে, যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’
– اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
– اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা মহামারি করোনাসহ যে কোনো কঠিন রোগে কোনো মুমিন-মুসলমানকে মৃত্যু দিলে তা হাসিমুখে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকা খুবই জরুরি। কেননা আগে হোক কিংবা পরে, জন্মের পর মানুষের মৃত্যু সুনিশ্চিত।
তাই সব সময় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে সদা প্রস্তুত থাকা মুমিন কাজ। আল্লাহর ফয়সালা মনে প্রাণে গ্রহণকারীর জন্যই রয়েছে সুবিশাল অনিন্দ্য সুন্দর জান্নাতের ঘোষণা। রোগ-মুসিবত-মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী মুমিন ঘুরে বেড়াবে সে জান্নাতে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝ দান করুন। অস্থিরতা, দিশেহারা হওয়া থেকে বিরত রাখুন। ধৈর্যধারণ করার তাওফিক দান কুরুন। আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন। মুমিন হিসেবে কবুল করুন। আমিন।