শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্র করেননি, শাস্তির সুযোগ নেই: যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির’ যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল কোনো ষড়যন্ত্র করেননি। তাদের শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগের যুক্তি খণ্ডন করে গতকাল মঙ্গলবার এসব কথা বলেন তিনি।
পরে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক অসমাপ্ত রেখে মামলার কার্যক্রম আজ বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
আমির হোসেন বলেন, সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি হিসেবে গত বছর আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের গুলির নির্দেশনা ছিল না। আন্দোলন দমাতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়ায় তারা কোনো অপরাধ করেননি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এবং প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের খালাস চাই।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশন অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের প্ররোচনায় পুলিশ গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। অথচ ট্রাইব্যুনালে কোনো সাক্ষীর বর্ণনায় এমন কোনো বক্তব্য আসেনি। ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার যে অভিযোগ প্রসিকিউশন করেছেন, তা সঠিক নয়।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশন বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতি রাতে কোর কমিটির বৈঠক হয়েছে। আমার বক্তব্য, কোর কমিটির বৈঠক হওয়া কোনো অপরাধ নয়। দেশে সৃষ্ট হওয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আন্দোলন কীভাবে প্রশমিত করা যায়, সে বিষয়ে কোর কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি বৈধ প্রক্রিয়া।
ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপেন ব্যবহারের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, একটি চলমান আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য এসব ব্যবহার কোনো অপরাধ নয়। ড্রোন ব্যবহার মানে এই নয়, ড্রোন থেকে গুলি করা হচ্ছে। কোনো জায়গায় বেশি আন্দোলনকারী একত্রিত হয়ে জানমালের ক্ষতি করতে পারে, সেই জায়গাটা ড্রোনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে আন্দোলনকারীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আর হেলিকপ্টার থেকে যদি গুলি করা হতো, তাহলে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, তা হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় হেলিকপ্টার থেকে গুলির দৃশ্য আমরা ভিডিওতে দেখেছি। তবে সেই গুলির নির্দেশ দেননি শেখ হাসিনা। প্রসিকিউশন যা বলছেন, সেটা তাদের মনগড়া ও নিজস্ব বয়ান। এগুলো আমার মক্কেল বিশ্বাস করেন না, আমারও ওই কথা।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল আমির হোসেনের কাছে জানতে চান, ওই সময় যাত্রাবাড়ী ও চানখাঁরপুল এলাকায় গুলি করার কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল কিনা? জবাবে আমির হোসেন বলেন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান তাঁর নির্দেশনায় বলেছিলেন, যদি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, লিলিং পজিশনে (কোমরের নিচে) থেকে পুলিশকে গুলি করতে।
আমির হোসেন বলেন, প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় সারাদেশে এক হাজার ৫০০ লোক নিহত ও ২৫ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
ট্রাইব্যুনাল আইনজীবী আমির হোসেনের কাছে জানতে চান, এতগুলো লোক মারা গেল এর দায় কে নেবে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, একটা সমাজে ভিন্নমত থাকতেই পারে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আইনের মাধ্যমে। কিন্তু মেরে ফেলতে পারবেন না। আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হলো– এটা কি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে পড়ে না?
জবাবে আমির হোসেন বলেন, কোনো পুলিশকে গুলি করার নির্দেশনা দেননি শেখ হাসিনা। যদি কোনো পুলিশ অতিউৎসাহী হয়ে গুলি করে হত্যা করে থাকেন, তাহলে সে দায় তার ব্যক্তিগত। কারোর ব্যক্তিগত দায় শেখ হাসিনা নেবেন না।
আমির হোসেন বলেন, জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন। এই নির্দেশনা কোনোটাই অবৈধ ছিল না। প্রসিকিউশনের অভিযোগ অমূলক বলে দাবি করেন তিনি।
প্রসিকিউশনের দাখিল করা কল রেকর্ডের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, কল রেকর্ডের যে অডিওগুলো এখানে শোনানো হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শুধু একটি সরকারি সংস্থার ফরেনসিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই এগুলোকে সঠিক দাবি করা হচ্ছে। অথচ প্রতিটি অডিও রেকর্ডের প্রতিবেদন ক্রসম্যাচিং হওয়া প্রয়োজন ছিল ভিন্ন একটি স্বতন্ত্র সংস্থা থেকে।
এদিকে ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আরও এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের এসআই আবদুল বারেক। পরে তাদের জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।