ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেড় যুগ ধরে লুটেপুটে খেয়েছেন নানক
দেশের প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত ‘দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়’। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেড় যুগ ধরে লুটেপুটে খেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতা তার তিন খলিফাকে সামনে রেখে হাজার কোটি টাকার এই সম্পদের আয় ১৮ বছর ধরে ভোগদখলে রেখেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের আয়ের শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে লোপাট করেছে এই চক্র। দীর্ঘ এই সময় ধরে বৈধ ট্রাস্টিদের পক্ষে উচ্চ আদালতের কোনো আদেশই কার্যকর করেনি পুলিশ। যে কারণে বছরের পর বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আয় লুটপাট করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের সব সম্পদ বৈধ ট্রাস্টি মুহাম্মদ ওসমান গনির নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকে বুঝিয়ে দিতে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ আদেশ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বৈধ ট্রাস্টিকে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সম্পদ বুঝিয়ে দিতে হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন। আমরা সেই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য দখলকারীদের দাপ্তরিক পত্র দিয়েছি। একই সঙ্গে ঢাকার পুলিশ সুপারকে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে ওসমান গনির নেতৃত্বাধীন ট্রাস্টিকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তদানীন্তন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাগুরার স্বনামখ্যাত মনীষী অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯৮৬ সালে ‘দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড’ গঠন করেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৮০ সালে ইসলামাবাদ, ১৯৮১ সালে ঢাকায়, ১৯৮২ সালে জাকার্তায় এবং ১৯৮৭ সালে কায়রোতে বিশ্ব মুসলিম মনীষীদের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ইসলামের একটি মূলনীতি ‘হায়ার এডুকেশন অন দ্য বেসিস অব প্রিন্সিপ্যালস অব হলি কুরআন অ্যান্ড সুন্নাহ’-এই মূলনীতিভিত্তিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয় সৈয়দ আলী আশরাফের ওপর। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় ট্রাস্টের নাম হবে ‘দারুল ইহসান ট্রাস্ট’ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে ‘দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়’। সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯৮৬ সালে ৬ সদস্যবিশিষ্ট দারুল ইহসান ট্রাস্ট গঠন করেন। এরপর সাভার গণকবাড়িতে অবস্থিত তার নিজস্ব ১৩ একর জমি রেজিস্ট্রি করে দান করে দেন। শুধু সাভারের সম্পত্তি নয় ধানমন্ডির ৯/এ নং রোড-এর ২১নং প্লটে নিজ বাড়ির দুটি ভবনের মধ্যে একটির একাংশ নিজের বাসস্থান হিসাবে রেখে সব সম্পদ ট্রাস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে দেন। ধানমন্ডির দান করে দেওয়া এই ভবনে দারুল ইহসানের যাত্রা শুরু হয়। এখানেই ট্রাস্টি বোর্ডের অফিস এবং দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও ক্লাসরুম হিসাবে অস্থায়ীভাবে শুরু হয়। ওই সময় বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না, তখন থেকেই শুরু হয় এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্টের নিজস্ব ভূমি গণকবাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরপর অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফের প্রচেষ্টায় ১৯৯২ সালে ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট’ পাশ হয়। ১৯৯৩ সালে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকা অবস্থায় চুয়াত্তর হাজার স্কয়ার ফিট ফ্লোর-বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মিত হয়। ভবনটি উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ। তারই সভাপতিত্বে ১৯৯৭ সালে ওই অ্যাকাডেমিক ভবনে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
সূচনা লগ্নেই বরেণ্যরা : দারুল ইহসান ট্রাস্ট ও তার মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, উভয়ই এ দেশের অতি মর্যাদাসম্পন্ন দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দারুল ইহসান ট্রাস্টের প্রথম চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ ওমর নাফিস, সৌদি পার্লামেন্টের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এবং প্রথম ট্রেজারার ছিলেন সৌদি সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী শায়খ সালেহ আহমেদ জুমজুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ, জাতীয় অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আহসান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ২০০৬ সালে নিবন্ধনের প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ড ১১ সদস্যবিশিষ্ট হয়। ২০০৬ সালের ২ এপ্রিল ১৮৬০ সালের সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের অধীন যৌথ মূলধনী কোম্পানির নিবন্ধকের অফিসে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধন নং-৫৫৪২ (৬৫৬)।
নানকের দখল যেভাবে : জানা যায়, দীর্ঘ ১৮ বছর দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ ট্রাস্টির পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ফয়জুল কবীর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ট্রাস্ট রেজিস্ট্রেশনের কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু ব্যক্তির কুনজরে পড়ে এই প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের ঘনিষ্ঠ ইশারফ হোসেন নামে একজন দারুল ইহসান ট্রাস্টের নিবন্ধন বাতিল করতে ঢাকার সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা নং-২১৩/২০০৬ দায়ের করেন। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সেই মামলাটির কোনোভাবে শুনানি ঠেকানো হয়। আদালত চত্বর থেকেই জানা গেল মামলাটির পেছনে আছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। ইশারফ তার অন্যতম শিক্ষিত ক্যাডার।’
তিনি বলেন, মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ইশারফ এবং নানকের আরেক সহযোগী মুকুল একদিন গভীর রাতে ২০-২৫ জন অস্ত্রধারী ধানমন্ডির ইহসান ট্রাস্ট ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস দখল করে নেন। ওই সময় ধানমন্ডি থানার পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি এই দখল প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেন। একই কায়দায় তারা সাভার গণকবাড়িতে দারুল ইহসান কমপ্লেক্সটিও জবরদখল করে দারুল ইহসান ট্রাস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের অফিস সরঞ্জাম লুট করে নেন। নিবন্ধিত ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং ট্রাস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকী থানায় এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে গেলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। বর্ষীয়ান এই আইনজীবী বলেন, জীবনের সব সম্বল ও আশা ভরসার স্থল দখল করে নেওয়ার পর ট্রাস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রতিষ্ঠাতা আপন ভাই অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফ এবং অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এরপরই সব দায়দায়িত্ব এসে বর্তায় তার নিজের (ফয়জুল কবীর) ওপর। এরপর থেকে তিনি প্রায় ১৮ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৯ অক্টোবর রিট পিটিশনের শুনানিতে দখলদারদের উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতের রায় বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঢাকার পুলিশ সুপার ও সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলা যায়নি।
-যুগান্তর