শিক্ষাক্রমে আরবি ভাষা বাধ্যতামূলকরাসহ শিক্ষাসংস্কার কমিশন গঠনের ২৩ দাবি
জাতীয় শিক্ষাক্রমে আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিরসনে শিক্ষাসংস্কার কমিশন গঠনের ২৩ দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ইসলামিক থট।
সোমবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ইসলামিক থট (বিআইআইটি) কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়।
বক্তব্যে বিআইআইটির মহাপরিচালক ড এম আবদুল আজিজ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে বহু শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ছিল শাসকগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনাকে সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ মানবিকতা, যুক্তিবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, এবং দেশপ্রেমের আদর্শ তুলে ধরা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সমন্বয়হীন একটি সেকেলে শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও, তার বাস্তবায়নও সফল হয়নি। ২০২১ সালে চালু করা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা নীতিনির্ধারণে অদূরদর্শিতার ও জাতিসত্তার সাথে সাংঘর্ষিক উপাদান থাকায় এটিও ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়াও উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে বিগত সরকারের গৃহিত সংশোধিত কৌশলগত কর্মপরিকল্পনার (২০১৮-২০৩০) ক্রিটিক্যাল রিভিও প্রয়োজন। নতুন বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত, নৈতিক, এবং দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার।
শিক্ষা সংস্কারে বিআইআইটির সুপারিশগুলো হলো-
১। জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে শিক্ষাদর্শন, ভিশন, মিশন, এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। দেশীয় সত্তা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণে, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন, দক্ষ এবং ভালো মানুষ গড়ে তোলাই প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে।
২। সকল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সাধারণ বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আলিয়া মাদ্রাসা বা কওমি মাদ্রাসা-সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। এসব বিষয়ের মধ্যে থাকবে: বাংলাদেশ পরিচিতি, ইতিহাস ও সভ্যতা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ধর্ম শিক্ষা। পাশাপাশি, ভাষাগত দক্ষতা ও কম্পিউটার দক্ষতা অর্জনকেও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩। শিক্ষায় যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শহর-গ্রামীন ভেদাভেদ দূর করে ভারসাম্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে, তাদের জন্য শিক্ষা বাজেটে অগ্রাধিকার নীতি চালু করতে হবে।
৪। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের সবার জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের মাধ্যমে শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া মেধাবীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এ লক্ষ্যে জেএসসি, পিএসসির আদলে ‘এডুকেশন সার্ভিস কমিশন (ইএমসি) গঠন করতে হবে- যা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈষম্যবিহীন হবে।
৫। সকল স্তরের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে জীবনমুখী দক্ষতা এবং বিষয়ভিত্তিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের যথাযথ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
৬। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, ব্যবহারিক দক্ষতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।
৭। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সকল স্তরে ফান্ডামেন্টালস অব রিলিজিয়ন (মুসলিমদের জন্য ফান্ডামেন্টালস অব ইসলাম) বিষয় বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ের সাথে ‘প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় কোর্স’ বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেমন, অর্থনীতিতে ইসলামি অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তা, আইনে ইসলামিক লিগ্যাল থিওরি ইত্যাদি।
৮। বিগত বছরগুলোতে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় উচ্চশিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য সংখ্যা না বাড়িয়ে গুণগত মানের দিকে নজর দেয়া উচিত। এ লক্ষ্যে ঢাকা ও জেলার পরিবর্তে বিভাগীয় শহরে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন/আনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
৯। দেশের শ্রম বাজার এবং বিশ্বশ্রমবাজারে জনশক্তি রপ্তানির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ডিপ্লোমা চালু করা উচিত, যাতে করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া কারিগরি ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করার জন্য কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সম্প্রসারণ, গবেষণা কার্যক্রম এবং শিক্ষা মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে জেলা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কারিগরি শিক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা উচিত।
১০। জাতীয় শিক্ষাক্রমে অবশ্যই বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি-তিনটি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে (আরবি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা, একই সাথে দেশের একটি বিশাল জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত)।
১১। সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য ‘Pedagogy Skills (Art of Teaching)-এর পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১২। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য জাতীয়ভাবে পৃথক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করতে হবে- যেখানে শিক্ষকদের প্রি-সার্ভিস ইন সার্ভিস প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া ঐ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষকদের বাধ্যতামূলক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদেশি ডিগ্রিধারী হতে হবে।
১৩। সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষানুরাগী শিক্ষক-শিক্ষাবিদ সদস্য, দাতা সদস্যের বাহিরে উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এ ছাড়া একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে কমিটিতে আওতাভুক্ত করা উচিত।
১৪। সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অবশ্যই স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি থাকতে হবে।
১৫। দেশের শিল্প এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর সাথে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগ চালু ও শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা, যাতে করে দেশকে ভিন্ন দেশ থেকে লোক নিয়োগ করতে না হয় (টিআইবি’র তথ্যমতে বাংলাদেশে ৫ লাখ ভারতীয় কর্মরত আছে)। যে বিষয়ে দেশের দক্ষ জনশক্তি দরকার, সেই পরিমাণ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় Corporate interest- এ সংযুক্ত অপ্রয়োজনীয় পাঠ্যবিষয়গুলো বাদ দিয়ে social interest-এ প্রয়োজনীয় নতুন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে, শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ নেই, সেগুলোকে ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে একীভূত করে বিলুপ্ত করতে হবে।
১৬। কওমি মাদ্রাসায় ভালো আলেম গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার স্বকীয়তা বজায় রেখে সিলেবাসকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে কওমি শিক্ষাবোর্ড ও অন্যান্য বোর্ডের মতো ক্ষমতায়িত করে শিক্ষকদের শিখন দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় শিক্ষকদের সরকারি এমপিও ভুক্তি করা যেতে পারে।
১৭। আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের মেইনস্ট্রিমে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদ্রাসার ইসলামি বিষয়ের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এবং বাধ্যতামূলকভাবে ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, মাদ্রাসা শিক্ষায় কারিগরি শিক্ষা ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণার ক্ষেত্রও তৈরি করতে হবে।
১৮। বাংলাদেশ প্রধানত কৃষিনির্ভর দেশ। তাই, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি উন্নত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
১৯। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো Affiliating University-র মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করা যাতে যত্রতত্র কলেজ-মাদ্রাসা গড়ে উঠতে না পারে এবং দক্ষ গ্র্যাজুয়েট বের হতে পারে।
২০। দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে Fully Research Based university তে রূপান্তরিত করা। এ ছাড়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ৬০ শতাংশ Teaching Based & 80% Research based -এ উন্নীত করা।
২১। প্রথম ও চতুর্থ আন্তর্জাতিক মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত (১৯৭৭-১৯৮৩) মক্কা ডিক্লেয়ারেশনে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গৃহিত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে যা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই, পরবর্তী শিক্ষা সংস্কার কমিশন অবশ্যই সেই ডিক্লেয়ারেশনে গৃহীত সুপারিশমালার বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে।
২২। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট মোকাবেলায় দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন অথবা জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে যেখানে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, দেশের শিল্প এবং শ্রমবাজারের সাথে পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২৩। কেবলমাত্র নিদিষ্ট ভিশন ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। যদিও, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তবুও, সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রমের পথে এখনো বহু বাধা বিপত্তি রয়েছে, যা অনতিবিলম্বে, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি- এ তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।