যা দেখেছি সিটি নির্বাচনে
বলে রাখা ভালো। নির্বাচনের আগের দিন রাতে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। আগেই ধারণা হয়েছিলো, ফলাফল তাদের পক্ষেই আসবে। যা হোক নির্বাচনের দিন সকাল ৮টার একটু আগে গেলাম গ্রীণ রোডের ওয়াই ডব্লিউ সি এ স্কুল কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে পুলিশের বাঁধার মুখে পড়লাম। গণমাধ্যম কর্মীদের কেন্দ্রে প্রবেশ নিষেধ। একজন এসআই দিয়ে খবর পাঠালাম প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে। তিনিও মহাব্যস্ত তাই তার অনুমতি মেলেনি।
এরই মধ্যে খবর এলো কাঁঠালবাগান হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিএনপির এক এজেন্টকে মেরে রক্তাক্ত করেছে সরকারি দলের কর্মীরা এবং তাদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। দশ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌঁছালাম। আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি? কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। এক মুরব্বির সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করলাম। গলায় গণমাধ্যম কর্মীর কার্ড ঝুলানো দেখে তিনিও বলেন, কথা বলা নিষেধ। এখানে কথা বললে তাদের ঝামেলা হতে পারে। ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশের কাছে জানতে চাইলে, তারা জানিয়েছিলেন এটা বাইরে হয়েছে। এটা তাদের জানার কথা না।
কাঠালবাগান থেকে বের হয়ে ধানমন্ডি ড. মালিকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্রে গেলাম, সেখানে কোনো ভোটার নেই। বাইরে আওয়ামী লীগের এজেন্ট ও সমর্থকদের ঘুরাঘুরি। বিএনপির এজেন্ট এ কেন্দ্রেও পাওয়া যায়নি। সিটি কলেজে একই চিত্র। হাতপাখার এজেন্টরা চারদিকে ঘুরছে। কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তারা অভিযোগ করেছিলেন, সকাল থেকেই তাদেরকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সরকার দলীয়রা। সকাল ৯টার দিকে বাইরে যে পরিমাণ সরকার দলীয় এজেন্ট এবং সমর্থক দেখেছি তার একভাগ ভোটারও চোখে পড়েনি।
দশ মিনিট পর গেলাম ঢাকা কলেজ কেন্দ্রে। সেখানকার দৃশ্য আরও ভয়াবহ। ভোটার নেই, কিন্তু বিশেষ দলের সমর্থক ও এজেন্টদের সংখ্যা এতো বেশি ছিলো, কেউ দেখলে মনে করবে ভোটরদের জট। বাস্তবে তা ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখি সব ছাত্রলীগের দখলে। সেখানে ভোটার ছিলো হাতে গোনা। তাদের নিয়ন্ত্রণেই কেন্দ্রগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোজা চলে গেলাম, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা। ভোটার নেই। তবে সেখানেও একই অভিযোগ। অন্য কোনো দলের এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রায় সকল কেন্দ্রেই ভোটারদের ইভিএম নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। পদ্ধতি নতুন হওয়াতে অনেকের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কারো আঙ্গুলের ছাপ মিলেছে তো ভোট আরেকজন দিয়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ আঙ্গুলের ছাপ না মেলার কারণে ভোট না দেয়ার নজিরও রয়েছে। এদিকে যারা ইভিএম মেশিন অপারেট করছিলেন তাদেরও যথেষ্ঠ প্রশিক্ষণের ঘাটতি ছিলো বলে আমার মনে হয়েছে।
সকাল ১০টার দিকে গেলাম পুরান ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে। সেখানে তিনটি কেন্দ্র। কেন্দ্রের ভেতরে ছিলো সরকার দলীয় লোকজন। ভেতরের পরিস্থিতি আমার কাছে বাজার মনে হয়েছে। ভোটারদের অভিযোগ ভোট দিতে পারছে না। প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, এখানে ভোটারের বাইরে এতো লোকজন কেনো? উত্তরে তিনি বলেন, তিনটা কেন্দ্র তাই লোকজনের সংখ্যা বেশি। এই প্রশ্ন করে দোতলা থেকে নামতে নামতেই দেখি পুলিশ সবাইকে বের করে দিচ্ছে। তার মানে প্রিজাইডিং অফিসারকে প্রশ্ন করায় কাজ হয়েছে। তবে এ কেন্দ্রে অনেকে অভিযোগ করছিলেন তাদের ভোট অন্যজনে দিয়ে দিয়েছে। অথচ আঙ্গুলে ছাপ তাদেরই ছিলো।
আধঘণ্টার পর গেলাম বকশি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, কোনো ভোটার নেই। তবে সেখান বর্তমান কাউন্সিলর দিক-বেদিক ঘুরছিলেন। তখনই সন্দেহ হলো, এখানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এমন ভাবনা মাত্রই দশ মিনিট পরই চারদিক থেকে ককটেলের শব্দ আসছিলো কানে। এ সময় আমরা কয়েকজন সংবাদকর্মী ঘটনাস্থলে ছিলাম। দুই-একটা ককটেল কানের এপাশ ওপাশ দিয়েও গিয়েছে। পুরো কেন্দ্রে ছিলো আতঙ্ক। বিশ মিনিট ধরে প্রায় আট দশটি ককটেলের শব্দ শুনতে পেয়েছি। এর বিশ মিনিট পর পুলিশ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনে। এই সময়টায় ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিলো। এরপর হুট করে ভোটার সংখ্যা বেড়ে গেলো। অনুসন্ধানী মনে খোঁজ করে জানতে পারলাম, বর্তমান কাউন্সিলরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের লাইনে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তারা। এ কেন্দ্রে এমন টান টান উত্তেজনা ছিলো সারাদিন।
বেলা সোয়া দু’টায় আবার গেলাম বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে। আমাদের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করেছে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন। এ সময় তিনি ভোটকেন্দ্রের কয়েকটি বুথ ঘুরে দেখেন। নারীদের একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, ভোটগ্রহণ বন্ধ। কক্ষের পোলিং এজেন্ট, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার- যার যার চেয়ারে বসেই দুপুরের ভাত খাচ্ছেন। ভোটগ্রহণ বন্ধ আছে। এটা দেখে তিনি মুচকি হাসি দিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। পরে তার কমেন্ট নেয়ার চেষ্টা করলে তিনি নো কমেন্টস বলে বেরিয়ে যান। ভোট বন্ধ করার বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে। তিনি দু:খপ্রকাশ করে বলেন, এটা খুবই দৃষ্টিকটু একটা ঘটনা। এই কলেজের আরেকটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখি প্রিজাইডিং অফিসার ও একজন এসআইকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। পরে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঘটনা কি? তিনি সত্যতা স্বীকার করেছেন। তবে কোন পক্ষ তাকে প্রস্তাব দিয়েছে তা তিনি বলেননি। আমার ধারণা তারা কোনো কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন হবে। তার বক্তব্য নিয়ে বের হওয়ার সময় একটি কক্ষকে পুরো বাজার মনে হয়েছিলো। গোপন ভোট কক্ষে তিনচারজনকে এক সঙ্গে দেখা মেলে। অন্যরা বাইরে দিক-বেদিক দৌঁড়াচ্ছিলো। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরা এসে তাদেরকে বের করে নিয়ে যায়। যদিও পরে আবার তাদেরকে দেখা গেছে। ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ২৮ বা ৩০ ভাগ ভোটের খবর পাওয়া যায়।
ভোটের দিনে আমার অভিজ্ঞতা বলেছে, ঢাকার দুই সিটিতে প্রথমবারের মতো ইভিএম-এ ভোটগ্রহণে বেশির ভাগ ভোটারকেই পড়তে হয়ে বিড়ম্বনায়। খেটে খাওয়া মানুষ আর সরকার দলীয় সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে বেশি দেখা মেলে। এর মধ্যে তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণির ভোটার সংখ্যা কম ছিলো। তবে ঘটনাবহুল ও ভোটে জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম বিড়ম্বনা নিয়ে নানা অভিযোগ ছিলো দিনভরই। বিশেষ করে বিরোধীপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, ভোটারের ছাপ নিয়ে গোপন কক্ষে গিয়ে আরেকজনকে ভোট দেয়ার অভিযোগ ছিলো অহরহর। আর গণমাধ্যমকর্মী তো হাফ ডজন নির্যাতিতই হয়েছে। নিজেও বাঁধার মুখে পড়েছি অনেকবার। এদিকে আমি যতগুলো কেন্দ্রে গিয়েছি, কোনো কেন্দ্রেই বিএনপির এজেন্ট পাইনি। অভিযোগ ছিলো বেশিরভাগ কেন্দ্রেই তাদের এজেন্ট প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তবে এসব কেন্দ্রে প্রবেশে বিএনপি এজেন্টদেরও সক্রিয় দেখা যায়নি।
এবার আসি ফলাফল ঘোষণা নিয়ে। আমি ছিলাম দক্ষিণ সিটির ফলাফল ঘোষণা কেন্দ্রে। নির্বাচন কমিশন যদিও বলে আসছিলেন, দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই ইভিএম ভোটের ফলাফল দেয়া সম্ভব। অথচ এ ফলাফল পেতে গণমাধ্যমকর্মীদের এগারো ঘণ্টা সময় লেগেছে। সকাল সাতটায় বের হয়ে মধ্যরাতে বাসায় ফিরেছি। আমার ধারণা, এই নির্বাচন কমিশন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।