ভোটার উপস্থিতি কমছে কেন
গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশের প্রধান নিয়ামক ভোটার। কিন্তু দেশে অনুষ্ঠিত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দিন দিন কমছে ভোটাধিকার প্রয়োগের হার। সর্বশেষ সব দল ও মতের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে চলেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার। ১ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণের দিনও পুরো পরিবেশ ছিল দৃশ্যত ভোটারবান্ধব। এর পরও দুই সিটি নির্বাচনে গড়ে মাত্র ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটার উপস্থিতির এ নিম্ন হার সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ নির্বাচন কমিশনেই (ইসি) চলছে এর কারণ অনুসন্ধান।
ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলামগীর বলেন, ‘আমি কেন্দ্রে না গেলেও সমস্যা নেই’- ভোটারদের অনেকের মধ্যে এ ধরনের একটি মনোভাব থেকেই হয়তো তারা ভোট দিতে আসেননি। তিনি আরও বলেন, আমাদের ধারণা ছিলÑ ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়বে। যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যত রকম কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত, তা করেছিল কমিশন। এর পরও ভোট কেন এত কম পড়ল, তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আয়োজন যাদের জন্য, তারাই এলো না। এর কি কারণ হতে পারে? ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, আমার মনে হয়েছে ভোটারদের প্রতি নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা অতোটা মনোযোগ দেননি। উপরন্তু অনেক প্রার্থী
আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে প্রচার চালানোয় ভোটাররা উল্টো বিরক্ত হয়েছেন। তিনি যোগ করেন, একজন ভোটারের ভোট যে মূল্যবান, এটি মনে করছেন না ভোটার নিজে। অনেক দিন ধরেই ভোটার উপস্থিতি কমছে, যা উদ্বেগের বিষয় বলেও মনে করেন তিনি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রচারে সবার অংশগ্রহণের কারণে তাদের ধারণা ছিল- এবারের সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৫০ শতাংশের বেশিই হবে। কিন্তু ভোটগ্রহণের দিন পরিবেশ উৎসবমুখর ছিল, তা বলা যাবে না। অনেক কেন্দ্র থেকে প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটি ভোটারদের উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেছে বলে তারা আসেননি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কায়ও কেউ কেউ ভোট দিতে যাননি। এ ছাড়া ভোট প্রদানের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করার পর গোপন বুথে প্রতীক নির্বাচনের সময় অন্য লোক জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকের বোতাম টিপে দিয়েছেন- এমন বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই। এ ছাড়া ইভিএমে ভোট প্রদানকালে ফিঙ্গার প্রিন্ট বিড়ম্বনায় পড়েছেন ভোটারদের কেউ কেউ। এ দুটি কারণও অন্যান্য ভোটারকে কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। ফলে ভোট পড়ার হার কম।
গতকাল বাম গণতান্ত্রিক জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের অনুপস্থিতি বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের গণহতাশা ও গণঅনাস্থার বহির্প্রকাশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের ভোট ডাকাতির নির্বাচন মানুষকে ভোটের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন সম্ভব সে বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে তুলেছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন। এর মধ্যে বৈধ ভোট দিয়েছেন ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৮৮ জন, বাতিল হয়েছে ১৫৬২টি ভোট। ঢাকা দক্ষিণের মোট ১,১৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস নৌকা প্রতীকে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ইশরাক হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন মিলন পেয়েছেন ৫৫৯৩ ভোট, ইসলামী আন্দোলনের আব্দুর রহমান পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট, এনপিপির বাহরানে সুলতান বাহার পেয়েছেন ৩১৫৫ ভোট, গণফ্রন্টের আব্দুস সামাদ সুজন পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট এবং বাংলাদেশ কংগ্রেসের আক্তারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ পেয়েছেন ২৪২১ ভোট।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮। এর মধ্যে বৈধ ভোট দিয়েছেন ৭ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৮ জন। ১৫৩০ জনের ভোট বাতিল হয়েছে। ঢাকা উত্তরে নৌকা প্রতীক নিয়ে মো. আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। এ ছাড়া হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলনের শেখ ফজলে বারী মাসউদ পেয়েছেন ২৮ হাজার ২০০ ভোট, কাস্তে প্রতীকে কমিউনিস্ট প্রার্থী আহম্মেদ সাজেদুল হক রুবেল পেয়েছেন ১৫ হাজার ১২২ ভোট, আম প্রতীকে আনিসুর রহমান দেওয়ান পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫৩ ভোট এবং বাঘ প্রতীকে শাহীন খান পেয়েছেন ২ হাজার ১১১ ভোট।
পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭ শতাংশ, দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ভোট পড়েছিল ৪৭ শতাংশ। তিন সিটিকে একদিনেই ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছিল। গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। এর পরে ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচনে ভোট পড়ে ৩১ শতাংশ। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে যে ২৯৪টি আসনে ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছে, সেখানে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ। ইভিএমে অনুষ্ঠিত ৬ আসেন গড়ে ভোট পড়েছে ৫১ শতাংশ। সর্বশেষ ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়, তাতে ভোট পড়ে মাত্র ২২.৯৪ শতাংশ।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে ভোট পড়েছে ২৯ দশমিক ০০২ শতাংশ। গড়ে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে অনুষ্ঠিত ৬ আসনে ৫১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে ব্যালটে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তরে ৩৭ শতাংশ এবং দক্ষিণে ৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচনে ভোট পড়ে শতাংশ।
ইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, এবারের ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে মূল নগরীর তুলনায় সর্বশেষ নগরীতে যুক্ত এলাকাগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশি, প্রায় ৪০ শতাংশ। মূল নগরীতে সেই তুলনায় ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। সব মিলিয়ে দুই সিটিতে গড়ে ভোট পড়েছে ২৭ শতাংশ। উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচারের পর ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রে ভোটার অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য নেতিবাচক বার্তাবাহী।