ভোটার না আসার দায় কার
জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের গত কয়েকটি নির্বাচনেই ভোটার খরা ছিল। এ নিয়ে প্রতিটি নির্বাচন শেষেই বেশ সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। ক্ষমতায় থাকায় কিছুটা হলেও সমালোচনা সইতে হয়েছে আওয়ামী লীগকেও। ভোটারের খরা কাটাতে তাই এবার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আয়োজন করে ইসি। আশায় ছিল অনেক বিতর্কের মধ্যেও ইভিএমের প্রতি আগ্রহী হয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন। কিন্তু তা হয়নি। গত নির্বাচনগুলোর মতোই এবারো ভোটার খরা দেখা গেছে নির্বাচনে। দিনভর বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
অন্যদিকে, শুরু থেকেই ইসি ইভিএমে দ্রুত ফল ঘোষণার কথা বলে এলেও শনিবার ভোট শেষে গণনায় সে কথার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। ঢাকা দক্ষিণের ফল ঘোষণা করতে মধ্যরাত গড়িয়ে যায়, উত্তরের ক্ষেত্রে সময় লাগে আরও বেশি। অর্থাৎ কাগুজে ব্যালটের মতোই সময় লেগে যায় ইভিএম ভোটের ফল ঘোষণায়।
গত শনিবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অল্প ভোটের এই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে দুই মেয়র পদেই জয় পান আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী উত্তরে আতিকুল ইসলাম ও দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস। এ ছাড়া ১২৯ জন নির্বাচিত সাধারণ কাউন্সিলরের মধ্যে ১২০ জনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং মাত্র ৯ জন বিএনপির।
এই দুই সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন। কিন্তু ভোট দিয়েছেন মাত্র ১৪ লাখ ৭২ হাজার ১৪৬ জন। প্রায় ৪০ লাখ ভোটার তাদের ভোট দিতে কেন্দ্রে আসেননি। তবে কয়েকটি কেন্দ্রে কিছু ভোটারকে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ঝগড়া করে এবং ইভিএম বুথে ঢুকে পড়ায় ভোট না দিয়েই কেন্দ্র ত্যাগ করতে দেখা গেছে।
সব মিলে নির্বাচন কমিশনের হিসাবে শনিবারের নির্বাচনে দক্ষিণে ভোট পড়েছে ২৯ দশমিক ০২ শতাংশ ও উত্তরে পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। গড়ে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও শনিবার ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশা করেছিলেন ভোটের হার ৩০ শতাংশের নিচে থাকতে পারে।
স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার খরার শুরু ২০০৮ সালের পর থেকেই। ইসির সূত্রমতে, ২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮১ দশমিক ৬১ শতাংশ। একই বছর বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৮১ দশমিক ৯৯ ও ৭৫ শতাংশ। কিন্তু এরপর ২০১৮ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কমে দাঁড়ায় ৭৮ দশমিক ৮৬, বরিশাল ও সিলেটে ৬২ শতাংশ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০১২ সালে ভোটের হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের নির্বাচনে সেই কুমিল্লায় ভোটার কমে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৫৯ শতাংশে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে এক দিনেই ভোট হয়েছিল। তাতে ব্যালট পেপারে গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। সেবার ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে ভোট পড়েছিল ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট পড়ে। নির্বাচনে ভোটারের খরা গত শনিবারও অব্যাহত ছিল। ইসির মূল চ্যালেঞ্জ ছিল
উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে পারেনি ইসি। ভোর থেকে কেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী, পোলিং এজেন্টদের আধিপত্য দেখা গেছে। এটি চলমান ছিল ভোটের শেষ পর্যন্ত। বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটের পরিবেশ ছিল শান্ত। ভোটার উপস্থিতিও ছিল নগণ্য। অনেক কেন্দ্রে ভোটের শুরু থেকেই ছিল ভোটারদের অনুপস্থিতি। দুপুর ২টার পর কিছু কিছু কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে।
কেন এই ভোটার খরা এ নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও নির্বাচন কমিশন নিজেদের মতো করে মন্তব্য করেছে। শনিবার ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের জানান, ভোটারকে কেন্দ্রে আনতে ইসির তৎপরতার কোনো ঘাটতি ছিল না। সেটা প্রার্থী, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতির কোনো কমতি নেই।
উত্তরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম আবার ছুটিকে কারণ দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছুটির কারণে অনেকে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন বলে ভোট দিতে পারেননি।
অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভোটকেন্দ্রগুলো ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ভয় তৈরি হয়েছে, এ কারণে মানুষ ভোট দিতে আসেনি।
গতকাল ইসি ভোটার খরার জন্য দলীয় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়াকে দায়ী করেছেন। এ ব্যাপারে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সব ভোটার যদি ভোট দিত, তাহলেও তো এত কম ভোট পড়ত না। তাদেরও (আওয়ামী লীগের) অনেক ভোটার ভোট দিতে যাননি।
তবে ইসির এই কর্মকর্তা ভোটার উপস্থিতির হারে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল, ৫০ শতাংশ ভোট পড়বে। কিন্তু তার চেয়ে কম পড়েছে। ভোট কাস্টিংয়ের দিক থেকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, এর কারণ বিএনপি নির্বাচনবিরোধী চরিত্র। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে বিএনপির নেতৃবৃন্দ ও তাদের প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হয় এমন ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বিএনপির আচরণ দেখে মনে হয়েছে তারা জয়ের জন্য নয়; বরং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং নির্বাচন সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে ইভিএম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য আরও প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্তটিও পুনর্বিবেচনা করা যায় কি না, সে বিষয়ে আলোচনার আহ্বান জানান নানক।
তবে ভোটাররা ‘ভোট দিয়ে কী হবে’ এমন মন্তব্যই বেশি করেছেন। উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ভোটার বলেছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে গেছে। ভোট দেওয়া না দেওয়া একই অর্থ। ভোট দিলেও যিনি জিতবেন, না দিলেও তিনিই জিতবেন। তাদের ভোট দেওয়া না দেওয়ায় কিছু যাবে-আসবে না। কারণ বিজয়ী কে হবেন, সেটা তারা জানেন। তাই তারা আর ভোট দেওয়ার দরকার মনে করেননি।
ভোটার খরার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অংশগ্রহণ না করার অন্যতম প্রধান কারণ এই নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ কমিশন। তাদের প্রতি জনগণের আর কোনো আস্থা নেই। এই কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ কমিশন। এ ছাড়া প্রতি ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন হস্তক্ষেপ করছে। তাই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসে না। জনগণ বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। এ থেকে বেরিয়ে আসার একটাই উপায়, হুদা কমিশনের মতো শক্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং কমিশনকে অবশ্যই সরকারের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে। তাদের জনগণকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, জনগণ তার ভোটাধিকার স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারবে।
একইভাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সর্বশেষ সিটি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে সেটা গণমাধ্যমকর্মীরা সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন। এটাকে কি কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায়? নির্বাচনের যে কয়টি ভোট পড়েছে, তা নিয়েও জনমনে সন্দেহ আছে। এ নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। মানুষ এখন আর এই কমিশনকে বিশ্বাস করে না। এ ছাড়া তারা নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগছে। এ কারণে জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসছে না। নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছতার মাধ্যমে পুনর্গঠন ও বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থায় যে ত্রুটিগুলো আছে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে তা দূর করতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) জাবেদ আলী বলেন, নির্বাচন কমিশন আহ্বান জানানোর পরও ভোটাররা নির্বাচনে আসছে না। এখন এখানে কমিশন কী করতে পারে। আমাদের দেশে ভোটাররা ভোট দিতে না গেলে কোনো আইন নেই। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে এ ধরনের কোনো কিছু করা যেতে পারে। অন্যথায় নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়বে।
ভোটারদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে এই সাবেক কমিশনার বলেন, ‘ভোট দিতে গিয়ে ভোটার যদি বাধার সম্মুখীন হন তাহলে সেটা প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাতে হবে। তিনি নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। কিন্তু ভোটাররা সেটাও করছে না। না জানালে কীভাবে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
ইভিএম যেমন ভোটার টানতে পারেনি, তেমনি সন্তুষ্ট করতে পারেনি ভোট গণনার ক্ষেত্রে। দুই সিটির ভোট গণনা শেষ করতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। সময় লাগে কাগুজে ব্যালটের মতোই। দেরির কারণ নিয়ে দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, প্রিসাইডিং অফিসাররা ট্যাবে রেজাল্ট পাঠাতে ভুল করেছেন, অনেকে ম্যানুয়ালি পাঠিয়েছেন।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভোটার উপস্থিতি না হলেও সরকারের চাহিদা মোতাবেক ওই কেন্দ্রে মোট ভোটের যত সংখ্যক প্রয়োজন তত সংখ্যক ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসাররা। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত ইভিএমের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির পথ ক্ষমতাসীন দলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
কোনো কারণে কারও আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বিধি মেনে মোট ভোটারের সর্বোচ্চ ১ শতাংশকে ভোটার হিসেবে শনাক্ত করে ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ভোটের দিন অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় সেই হার বাড়ানো হলেও কতটুকু বাড়ানো হয়, সেটা ইসি জানায়নি। তবে সিইসি বলেছেন, ইভিএমে কখনো একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না। একবার ভোট দেওয়া হয়ে গেলে ওই লোক আরেকবার পারে না।