বিপজ্জনক পথে পুতিন

0

ভ্লাদিমির পুতিন তার বর্তমান প্রসিডেন্টে হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতা যে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বৈরশাসকরা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন এমন নজির নেই বললেই চলে।

বিশেষত যে সব স্বৈরশাসক যুদ্ধ, নির্যাতন ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেন, তারা ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করতে পারেন না।

পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্যই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু পুতিন দাবি করেছেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে যে রীতি মেনে চলা হতো অর্থাৎ আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার ধারায় রাশিয়াকে তিনি ফিরিয়ে নিতে চান না।

গত শনিবার রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন। রয়টার্স বলছে, সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে আলোচনার জন্ম দেয়ার কয়েক দিন পর পুতিন এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে চলা জল্পনার অবসান ঘটাতে চাইছেন।

সম্প্রতি ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণে পুতিন গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানে বড় ধরনের সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেন। পুতিন তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষে হওয়ার আগেই সংবিধানের আমূল সংশোধনের জন্য গণভোটের প্রস্তাব করলেন। আর তার প্রস্তাবের পর প্রধানমন্ত্রী মেদভেদেভ ও তার সরকার পদত্যাগ করে। একই সাথে দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং পার্লামেন্টের নতুন স্পিকারের নাম ঘোষণা ও তা অনুমোদন করা হয়। ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড রাশিয়া এই অনুমোদন দিয়েছে। পদতাগের ঘোষণা দিয়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে রাশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, নির্বাহী ক্ষমতা, আইনসভার ক্ষমতাসহ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার ভারসাম্যেও আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এ প্রেক্ষাপটেই বর্তমান সরকার পদত্যাগ করেছে।

পুতিন তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার চার বছর আগেই সংবিধান পরিবর্তনের এই পথ বেছে নিয়েছেন। রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, কেউ টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারেন না। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সাল থেকে পুতিন চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন দু’বার।

২০১২ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে পার্লামেন্ট সদস্যদের দিয়ে পুতিন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চারবছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করিয়েছেন।
স্টেট অব দ্য ইউনিয়নে ভাষণে পুতিন বলেছেন, তিনি দেশব্যাপী গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টের হাত থেকে ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে স্থানান্তর করতে চান। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষকে আরো ক্ষমতাশালী করতে চান বলে তিনি জানান।

বর্তমানে পুতিন টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালে। সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের পর তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না।

সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দিয়ে নতুন সরকার গঠনের পর প্রশ্ন ওঠেছে, পুতিন কি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন? স্ট্যালিনের পর রাশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসক পুতিন। প্রায় ২০ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা পুতিন কখনো প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কখনোবা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এভাবে তিনি রাশিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকে পরিণত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার খায়েশ আগে থেকেই। তিনি তাই নানা কৌশলে বারবার ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা তৃতীয় মেয়াদে সংবিধান অনুসারে তার ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। তাই কিভাবে কোন পথে তিনি আবার ক্ষমতায় আসতে চান তা পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলছেন, আবারো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তিনি। পার্লামেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে এ জন্যই। তবে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের মত, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান নজরবায়েভের মতো তিনি সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতে চান। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কাজাখস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন নজরবায়েভ। দেশটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। নজরবায়েভ ২০১৮ সালে কাজাখস্তানের সিকিউরিটি কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং আজীবনের জন্য এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন। পুতিনের ভাষণে সংবিধান সংশোধনের যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, পুতিনও সে পথে হাঁটছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, পুতিন ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ করে চার বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মূলত আড়াল থেকে তিনিই দেশ পরিচালনা করেছেন। এরপর ২০১২ সালে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে স্বৈরাচারী শাসকরা অবসর পছন্দ করেন না। কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা পুতিন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তাই গত দুই দশক ধরে তিনি দেশটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। পুতিন মনে হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটি তাকে ছাড়া পরিচালনা করা সম্ভব নয়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার প্রেসিডেন্সিয়াল মেয়াদের ব্যবস্থা শেষ করে দিয়েছেন। পুতিন কি অন্য কায়দায় সে পথ অনুসরণ করতে চান। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফেরার ঘোষণা ও নির্বাচনের পর রাশিয়ার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তাই তার আজীন ক্ষমতায় থাকা কি খুব সহজ হবে?

পুতিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট ও অভিজাতদের জন্য নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও খুব সহজ হবে না। তবে পুতিন বেশ পাকা খেলোয়াড়। কিন্তু আজীবন তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন- এটা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে? পুতিনের আজীবন ক্ষমতায় থাকার মহাপরিকল্পনা কতটুকু সফল হবে- তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। আগামী বছর রাশিয়ায় পার্লামেন্ট নির্বাচন। তাই গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠলে পরিস্থিতি বিপজ্জনকও হতে পারে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com