ঢাবি ছাত্রীর ওপর পাশবিকতা

রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বর্বরতার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভে উত্তাল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ধর্ষককে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ঘটনার প্রতিবাদে নজিরবিহীনভাবে সব ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। তারা শাহবাগ ও কুর্মিটোলা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে ঘটনার প্রতিবাদ জানান। সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে হয় প্রতিবাদী মশাল যাত্রা। আজও একই ধরনের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গত রোববার রাতে কুর্মিটোলা এলাকায় বাস থেকে নামার পর ধর্ষণের শিকার হন ওই ছাত্রী।

ওইদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় বাসযোগে ক্যাম্পাস থেকে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার পথে কুর্মিটোলা বাস স্টপেজের সামনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাকে পেছন থেকে মুখ চেপে ধরলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর ভুক্তভোগীকে বাস স্টপেজের পাশে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে গলফ ক্লাব সীমানার শেষ প্রান্তে ঝোপের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করে ওই দুর্বৃত্ত। ভুক্তভোগীর শরীরে ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। এছাড়াও তার শরীরে আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। এদিকে ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদ, অভিযুক্তকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে রাতেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাধারণ  ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ পৃথক এ বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। গতকালও দিনভর বিক্ষোভ মিছিল ও সামাবেশে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সন্ত্রাস বিরোধী ছাত্রঐক্য, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের ব্যানারে এসব কর্মসূচি পালিত হয়। ঘটনার প্রতিবাদে অনশনে বসেছেন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী। বিকালেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে রাজু ভাস্কর্যে প্রতিবাদী গান ও স্লোগানে মুখর হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়েছে রাজধানীর শাহবাগ ও কুর্মিটোলার ঘটনাস্থলেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, কোনো ধরনের ‘আইওয়াশমূলক’ কথা না বলে ধর্ষকের দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করলে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ছেড়ে দেবে না। তিনি ধর্ষককে গ্রেপ্তারে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন। সন্ধ্যায় ডাকসু ভবনের সামনে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত নিপীড়ন বিরোধী পদযাত্রা ও আলোক প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। রাত ৯টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্মারকলিপি ও অপরাধীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা চেয়েছেন ডাকসু নেতৃবৃন্দ। এদিকে ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদ ও দোষীদের গ্রেপ্তারে পৃথক বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও বিএনপি জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা একজনকে অভিযুক্ত করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীর বাবা। গতকাল শাহবাগ থানায় পৃথক আরেকটি মামলা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন, ছাত্রী ধর্ষণে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, রোববার ক্লাস শেষে ক্যাম্পাস থেকে সাড়ে ৫টার বাসেযোগে কুর্মিটোলায় বান্ধবীর বাসার উদ্দেশ্যে বের হন ভুক্তভোগী। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি কুর্মিটোলা বাস  স্টপেজে নামার পর ২৫ থেকে ৩০ বছরের অজ্ঞাত এক ব্যক্তি পিছন থেকে তার মুখ চেপে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে নিয়ে যায়। এসময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর বাস স্টপেজের পাশে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে গলফ ক্লাব সীমানার শেষ প্রান্তে ঝোপের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করে ওই দুর্বৃত্ত। রাত ১০টার দিকে জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে একটি নির্জন এলাকায় পান। এরপর তিনি বান্ধবীর বাসায় যান। রাতে তার বান্ধবী ও অন্য সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানীকে বিষয়টি অবহিত করে ভুক্তভোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন। ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী, ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ছাত্রীর চিকিৎসা দেখভাল ও বিচার পেতে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর কথা জানান। আর ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। ভুক্তভোগীর এক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, কুর্মিটোলায় বান্ধবীর বাসায় যেতে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা বাসে ওঠেন ওই ছাত্রী। বাস থেকে কুর্মিটোলা এলাকায় নামার পর অজ্ঞাতপরিচয় একজন তার মুখ চেপে ধরে। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তাকে পাশের এক নির্জন এলাকায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। রাত ১০টার দিকে চেতনা ফেরার পর তিনি বান্ধবীর বাসায় যান। বান্ধবীকে ঘটনা জানান। এরপর সহপাঠীরা তাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ভুক্তভোগীর বরাত দিয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ২৫-৩০ বছর বয়সের অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাকে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর পাশের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। তিনি বলেন, ছাত্রীর শরীরের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন চিকিৎসকরা: এদিকে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢামেকের চিকিৎসকরা। ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফরেনসিক পরীক্ষায় ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তার গলায় আঙুলের দাগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল। হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সারা পায়ে খোঁচা লাগার দাগ রয়েছে। ঝোপের মধ্যে ধর্ষণের কারণে এ দাগ হতে পারে। ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, নারী চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামত পেয়েছি। একজন নাকি একাধিক ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে, তা নিশ্চিত হতে আলামত সংগ্রহ করেছি। সেগুলোর ডিএনএ অ্যানালাইসিস ও টেস্ট সম্পন্ন করতে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসার পর বোঝা যাবে একজনের হাতে নাকি গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি। ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, ওই ছাত্রী ট্রমায় ভুগছেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, মেয়েটির মেন্টালি ট্রমা ছাড়াও শারীরিক কিছু আঘাত রয়েছে। পাশাপাশি সে কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে এবং আমরাও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এ অবস্থায় তার সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা তার জন্য অস্বস্তিকর। কেউ যেন আমরা তার কাছে না যাই। বিগ্রেডিয়ার নাসির বলেন, ধর্ষণের বিষয়টি ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগ দেখছে। পাশাপাশি তাকে ঢামেকের নাক-কান-গলা বিভাগ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তার যেহেতু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেজন্য রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগসহ আরও কিছু বিভাগের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢামেক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভুক্তভোগীর চিকিৎসায় ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন গাইনি বিভাগের অধ্যাপক সালমা রউফ।
রাতেই বিক্ষোভ ক্যাম্পাসে: এদিকে ঘটনা জানতে পেরে রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরীসহ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃবৃন্দ এসময় উপস্থিত ছিলেন। এসময় তারা ধর্ষণ বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। দাবি করেন অবিলম্বে দোষীকে গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের। এরপরই রাত পৌনে ৪টার দিকে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এসময় তারাও এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন।
ধর্ষককে গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম: এদিকে ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদ, ধর্ষককে দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর। গতকাল রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক বিক্ষোভ শেষে এ ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে দুপুরে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও বাম সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাস বিরোধী ছাত্র ঐক্য শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। সেখানে বিক্ষোভ শেষে একটি মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের কর্মসূচি শেষ করে। এ কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, কোনো ধরনের ‘আইওয়াশমূলক’ কথা না বলে ধর্ষকের দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করলে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ছেড়ে দেবে না। তিনি বলেন, শুধু আইওয়াশমূলক কথাবার্তা না বলে দ্রুত ধর্ষণকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কোনোভাবেই এই ঘটনা ছেড়ে দেবে না। তিনি আরো বলেন, এর আগে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিচারহীনতার কারণে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আজকে দেশে মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আজকে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বসে থাকার সুযোগ নেই। আমি ছাত্র-জনতাকে সম্মিলিতভাবে এ ধরনের ঘটনা রুখে দিতে আহ্বান করছি। শুধুমাত্র বক্তব্য, সেমিনার ও নারীর অধিকার নিয়ে কথা বললেই হবে না। এসময় ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে ‘লঘু শাস্তির’ ফলে বর্তমানে দেশে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, আমাদের দেশে কোনো ঘটনার পরই তথ্য-প্রমাণ গায়েব হওয়ার নজির রয়েছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, এই ঘটনার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহপূর্বক দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।
ন্যায় বিচার পেতে পাশে থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-ভিসি: এদিকে ছাত্রী ধর্ষণের খবর শুনে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এসময় তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ভুক্তভোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ঘটনাটি খুবই নিন্দনীয়, দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা মর্মাহত। তার বাবা ভেতরে আছে, তবে আমরা সবাই তার পাশে আছি। তাকে মানসিকভাবে শক্ত ও সমর্থ করে তোলাই আমাদের প্রধান কাজ। তিনি বলেন, প্রথমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছে। মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো আমাদের প্রথম দায়িত্ব। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োজন তাই করা হবে। তাকে মনে রাখতে হবে সে আমাদের মেয়ে, আশা রাখি তার মনোবল শক্ত থাকবে। অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, তার অভিভাবকত্ব যেহেতু আমাদের, তাই তার সর্বোত্তম দায়িত্ব আমাদের। আমাদের সবটুকু তার জন্য নিবেদিত। পুলিশ এ ঘটনায় তৎপর আছে। দ্রুততম সময়ে দোষীদের আটক করে আইনের আওতায় আনার জন্য তাদের অনুরোধ করেছি।
ভুুক্তভোগীর পিতা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মামলা: এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে। গতকাল সকালে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগীর বাবা। আর শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি কাজী শাহান হক ও শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ছাত্রলীগের বিক্ষোভ: এদিকে দুপুর ১১টার দিকে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সহস্র শিক্ষার্থীর এ মানববন্ধন থেকে অবিলম্বে ধর্ষকের গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দাবি করা হয়। এসময় শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করেন। যাতে ধর্ষণ বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান লেখা ছিল। মানবন্ধননে ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদার বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেগে থাকবে। রোকেয়া হল সংসদের জিএস সায়মা আক্তার প্রমি বলেন, আমরা এর আগেও এখানে ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে দাঁড়িয়েছিলাম। আজকেও দাঁড়িয়েছি। আমরা বলতে চাই, আমরা এই ধর্ষণের বিচার না পাওয়া পর্যন্ত এখানে অবস্থান করবো। এসময় আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। তিনি বলেন, যারা আপনাদের আশপাশে বিভিন্ন খারাপ কটূক্তি করে, তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ গড়ে তুলুন। সামাজিকভবে তাদের বয়কট করতে হবে। জয় বলেন, মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেলা ১১টায় মানববন্ধন হবে। বুধবার ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি ইউনিটকে মানববন্ধনের আয়োজন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডাকসুর এজিএস ও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, এই আন্দোলন শুধু ঢাবির শিক্ষার্থী বলে নয়; দেশের যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও যদি সেক্সচুয়াল হেরেজমেন্ট করা হয় তার প্রতিও যেন অবিচার না হয় সেই লক্ষ্যেই এই আন্দোলন।
ছাত্রদলের বিক্ষোভ: এদিকে একই ইস্যুতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। গতকাল দুপুর ১১টায় মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রীর ধর্ষণের প্রতিবাদ ও সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সংগঠনটি। এরপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে অপরাজেয় বাংলায় এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এসময় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ধর্ষণের জন্য সরকারের সমালোচনা করেন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল সেখানে বলেন, গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এটা দেশের সামগ্রিক চিত্র। এ সরকারের আমলে ধর্ষণের শিকার কোনো নারী বিচার পায়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে ‘গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ বেড়েছে’। তাই এ সরকারের পতন ঘটাতে রাজপথে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।
ধর্ষণের প্রতিবাদ ও শাস্তি দাবি ঢাবি শিক্ষক সমিতির:  এদিকে গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে ধর্ষককে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, আমরা অত্যন্ত বেদনাহত চিত্তে ও তীব্র ক্ষোভের সাথে জানাচ্ছি যে, গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী কুর্মিটোলা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস থেকে নামলে কিছু দুর্বৃত্ত কর্তৃক অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা এই মানবতাবিরোধী জঘন্য ও পাশবিক ঘটনায় ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাই। এতে আরো বলা হয়, শিক্ষক হিসেবে আমাদেরই সন্তানতুল্য একজন ছাত্রীর প্রতি এহেন পৈশাচিক উন্মত্ততায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, বেদনাক্লিষ্ট ও ক্ষুব্ধ। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, ধর্ষণ একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরণিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্য, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং কখনো কখনো সঠিক তদন্তের অভাবে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সমাজে ধর্ষণ-ব্যাধিরবিস্তার ঘটে চলেছে, আমাদের এখনই এসবের মূলোৎপাটনে রুখে দাঁড়াতে হবে, নতুবা এটি অধিকতর মহামারি আকার ধারণ করবে- যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি অসহনীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। একইসাথে আমরা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য কাজের অবসানকল্পে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। আমরা অনতিবিলম্বে ধর্ষণের সাথে যুক্ত নরপিশাচদের গ্রেফতার দাবি করছি এবং তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করব, তনুসহ অপরাপর ঘটনার মতো ধর্ষণ ও নিপীড়নমূলক অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী যেন আর নিভৃতে না কাঁদে- সেজন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে পৃথক আরেক বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের বিচার দাবি করেছে। সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, রাজধানী ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় আমরা বিষ্মিত ও ক্ষুব্ধ। এ পৈশাচিক ঘটনার আমরা তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছি। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন না থাকায় আজকে প্রকাশ্যে ঢাবির ছাত্রীকে ধর্ষণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে নরপিশাচরা। দেশে নারীর নিরাপত্তাহীনতা কোন পর্যায়ে আছে ঢাবি শিক্ষার্থীর ধর্ষণের ঘটনা এর প্রমাণ। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি ক্ষমতাসীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনেই ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের উদাসীনতার সুযোগে দুস্কৃতিকারীরা ধর্ষণের মতো নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। কুমিল্লায় তনু হত্যা, ফেনীতে নুসরাত হত্যাসহ অসংখ্য নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বর্তমানে সরকারের আমলে। কিন্তু এ সকল ঘটনাসমূহের সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার হয়নি বলে দেশে নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেই চলছে। যার সর্বশেষ শিকার ঢাবির ছাত্রী। আমরা অবিলম্বে দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।

Comments (০)
Add Comment